২০২৪ সালের জুলাইয়ে চলা বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন যখন তীব্র আকার ধারণ করতে শুরু করে, তখন নির্ঘুম রাত কাটিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন শেখ হাসিনা। আন্দোলন দমাতে দিতে থাকেন বিভিন্ন প্রাণঘাতী নির্দেশ।
এরই মধ্যে জুলাই আন্দোলন চলাকালে শেখ হাসিনার বিভিন্ন কলরেকর্ড নিয়ে বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। এর একটি অংশে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনানের সাথে হাসিনার একটি কলরেকর্ডের অংশও ছিল। সেখানে হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি আন্দোলনের সময়ে সারারাতই নির্ঘুম কাটিয়েছেন।
ওই ফোনালাপে ওয়ালি আসিফ ইনান শেখ হাসিনাকে সালাম দিয়ে বলেন, ‘ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ছেলেদের হল অধিকাংশই ফাঁকা হইছে, এরপরও ভিতরে পুলিশের সার্চ করতে হবে। আমাদের দলীয় সিনিয়ররাও প্যানিকড হয়ে যাচ্ছিল যে, কী করব, ডিরেকশন দিতে পারতেছে না। এজন্য আজকে আপনাকে বারবার ফোন দিচ্ছি, আপনি কিছু মনে কইরেন না।’
জবাবে হাসিনা বলেন, ‘আমি কেন মনে করব, আমি তো সেদিন সারারাতই জাগা, কালকেও তো। আমি তো বলেছিই, আর তারা ঘাবড়ায়ে যায়।’
এরপর ইনান বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীরা মাঠে ছিল। আপনার নির্দেশনা পাইয়াই সবাই নাইমা গেছে।’
আল-জারিরা প্রকাশিত এসব ফোনালাপ এরইমধ্যে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ফোনালাপে হাসিনা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট বলছে, তারা এ বিষয়ে শেখ হাসিনার একাধিক গোপন ফোনালাপের অডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে স্পষ্টভাবে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে শোনা গেছে।
অডিওটি বিশ্লেষণ করে অডিও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন, এসব কল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দ্বারা তৈরি বা বিকৃত নয়। আর কণ্ঠ শনাক্ত করা হয়েছে ভয়েস-ম্যাচিং প্রযুক্তির মাধ্যমে।
প্রকাশিত অডিও অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তারিখে জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) একটি ফোনালাপ রেকর্ড করে, যেখানে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তার নির্দেশনা এর মধ্যেই দেওয়া হয়েছে। তিনি পুরোপুরি আদেশ দিয়েছেন। এখন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, যেখানে পাবে, সেখানেই গুলি করবে। তিনি এতদিন থামিয়ে রেখেছিলেন…।
শেখ হাসিনার সাথে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবং শেখ হাসিনার আত্মীয় শেখ ফজলে নূর তাপসের সাথেও আলাপ হয়, যেখানে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের কথাও বলেন তিনি। হাসিনা বলেন, ‘ওপরে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি জায়গায় শুরু হয়ে গেছে। কিছু বিক্ষোভকারী সরে পড়েছে।’
তবে সে সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী আকাশপথে গুলি চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। কিন্তু ঢাকার পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. শাবির শরীফ বলেন, ‘তারা এমন গুলিবিদ্ধ ছাত্র পেয়েছেন, যাদের শরীরে বড় আকারের গুলি ছিল, যা সাধারণত দেখা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘বুলেটগুলো কাঁধ বা বুকের ভেতর ঢুকেছিল এবং শরীরেই রয়ে গিয়েছিল। এক্স-রে দেখে আমরা বিস্মিত হই, কারণ এগুলো ছিল অস্বাভাবিক বড় বুলেট।’ তবে ঠিক কী ধরনের গুলি ব্যবহার করা হয়েছে, তা আল-জাজিরা নিশ্চিত করতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) জানায়, শেখ হাসিনা, তার কয়েকজন মন্ত্রী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ১০ জুলাই হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা হয় এবং আগস্টে বিচার শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
চলমান তদন্তে জানা যায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নজরদারি সংস্থা এনটিএমসি এই কলগুলো রেকর্ড করেছিল, যারা শুধু বিরোধী নেতাদের নয়, হাসিনার নিজের ঘনিষ্ঠ মহলের লোকজনের ওপরও নজরদারি করত।
আইসিটি-এর প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা জানতেন তার ফোনালাপ রেকর্ড করা হচ্ছে। অনেক সময় কলের অন্যপ্রান্ত থেকে বলা হতো, ‘ফোনে এটা আলোচনা না করাই ভালো’, তখন শেখ হাসিনা নিজেই বলতেন, ‘জানি, জানি, রেকর্ড হচ্ছে, সমস্যা নেই’।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আল-জাজিরাকে পাঠানো এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়, হাসিনা কখনো ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহারের কথা বলেননি এবং তার ফোনালাপের রেকর্ড ‘আংশিক কাটা, বিকৃত বা উভয়ই হতে পারে’। তারা আরও জানায়, আবু সাঈদের মৃত্যুর তদন্তে সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট আন্তরিকতা ছিল।
এই কল রেকর্ডগুলো আইসিটি-তে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হতে পারে। সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের পতনকে ঘিরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তাপ নতুন মাত্রা পেয়েছে।