ঢাকা বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০২৫

‘টাইফুন ব্লক-৪’: যুগান্তকারী হাইপারসনিক যুগে প্রবেশ করল তুরস্ক

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ২৩, ২০২৫, ০৯:২৫ এএম
মঙ্গলবার আইডিইএফ ২০২৫-এ হাইপারসনিক মিসাইল ‘টাইফুন ব্লক-৪’ উন্মোচন করে তুরস্ক। ছবি- সংগৃহীত

প্রথমবারের মতো হাইপারসনিক মিসাইল ‘টাইফুন ব্লক-৪’ উন্মোচন করে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল তুরস্ক। মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা মেলা আইডিইএফ ২০২৫-এ এই হাইপারসনিক মিসাইল উন্মোচন করে দেশটি। এ ছাড়াও তুরস্কের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান রোকেটসান ছয়টি নতুন উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি প্রদর্শন করেছে। বার্তা সংস্থা আনাদোলুর এক প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, টাইফুন ব্লক-৪ হলো তুরস্কের সবচেয়ে দীর্ঘপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘টাইফুন’-এর হাইপারসনিক সংস্করণ।

রোকেটসানের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সাত টনের বেশি ওজনের এই নতুন টাইফুন সংস্করণটি অনেক দূরে অবস্থিত প্রতিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার, সামরিক হ্যাঙ্গার এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করতে সক্ষম।’

এর আগে গত জুনে সংবাদমাধ্যম পিবিএস নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হাইপারসনিক অস্ত্র এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শব্দের গতির পাঁচগুণ অর্থাৎ ম্যাক ৫ বা তার বেশি গতিতে ছুটে চলা যেকোনো ক্ষেপণাস্ত্রকেই হাইপারসনিক বলা হয়। যদিও প্রচলিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অনেক সময়ই এই গতি ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান সময়ে হাইপারসনিক অস্ত্র বলতে এমন এক প্রযুক্তিকে বোঝানো হচ্ছে, যা শুধু দ্রুতগতিরই নয়, বরং উচ্চমানের ন্যাভিগেশন সিস্টেমের মাধ্যমে দিক পরিবর্তন করতেও সক্ষম।

রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং সম্প্রতি বলেছেন, ‘এ ধরনের অস্ত্র প্রচলিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।’

প্রচলিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সাধারণত এমন এক গতিপথে চলে যা আগেভাগেই অনুমান করা যায় এবং সেটি ধ্বংস করার জন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও প্রস্তুত থাকতে পারে। অন্যদিকে, ক্রুজ মিসাইল বা হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় চলার কারণে রাডার সিগনালের দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে চলতে পারে।

ওয়াটলিং বলেন, ‘যদি ক্ষেপণাস্ত্রটি একটি হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল হয়, তাহলে এটি কম উচ্চতায় ছুটতে পারে এবং রাডার তা ধরতে সময় নেয়। ফলে এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানানোর সময়ও কম পাওয়া যায়।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন নতুন প্রজন্মের হাইপারসনিক অস্ত্র সফলভাবে তৈরি করেছে। যদিও এখনো এই অস্ত্র তারা ব্যবহার করেনি। এর বাইরে রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং পাকিস্তান হাইপারসনিক গতিসম্পন্ন অস্ত্র পরীক্ষা করেছে। তবে সেগুলোর মান নতুন প্রজন্মের হাইপারসনিক অস্ত্রের তুলনায় কম।

এর আগে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের সময় ইরান দাবি করেছিল, তাদের কাছে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে এবং তারা ইতোমধ্যেই এই অত্যাধুনিক অস্ত্র ইসরায়েলের ওপর নিক্ষেপ করা শুরু করেছে। তবে এই দাবির পক্ষে এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং বিশেষজ্ঞরাও এর সত্যতা নিয়ে সন্দিহান।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে যেভাবে হাইপারসনিক শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে অনেক সময় এর প্রকৃত অর্থ হারিয়ে যাচ্ছে। এটি প্রতিযোগিতা ও ভয়ভীতি ছড়ানোর উপকরণে পরিণত হচ্ছে।’

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা হাইপারসনিক অস্ত্র স্টেলথ ডেস্ট্রয়ারে স্থাপন করতে যাচ্ছে এবং আরও উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষার কাজ চলছে।

চীন তাদের প্রথম হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ২০১৭ সালে পরীক্ষামূলকভাবে উৎক্ষেপণ করে এবং এরপর থেকে একাধিক হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরি করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের মতে, হাওয়াই, আলাস্কা এমনকি মূল ভূখণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ সতর্ক করে বলেছেন, ‘চীন সামরিক প্রযুক্তিতে, বিশেষ করে হাইপারসনিক অস্ত্রে বিপুল বিনিয়োগ করছে। এটি ভবিষ্যতে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।’

বিশ্বব্যাপী হাইপারসনিক অস্ত্রের এই প্রতিযোগিতা এখন শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক প্রভাবও সৃষ্টি করছে, যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের পথে নিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।