যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ভারতে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক উঠেছে। ম্যাকডোনাল্ডস, কোকাকোলা থেকে শুরু করে অ্যামাজন ও অ্যাপলের মতো জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলো এই প্রচারণার মুখে পড়েছে।
দেশটির ব্যবসায়ী এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমর্থকেরা এই মার্কিনবিরোধী মনোভাবকে উসকে দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। সোমবার (১১ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে ভারত আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলোর জন্য একটি বিশাল এবং ক্রমবর্ধমান বাজার। এখানে মেটার হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ এবং ডমিনোজের রেস্তোরাঁর সংখ্যা অন্য যেকোনো ব্র্যান্ডের চেয়ে বেশি। পেপসি ও কোকাকোলার মতো পানীয় দোকানের শেলফে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। এমনকি নতুন অ্যাপল স্টোর খোলা হলে বা স্টারবাকসে ছাড় দেওয়া হলে মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়।
তবে মার্কিন পণ্য বয়কটের ডাকে কোম্পানিগুলোর বিক্রিতে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বড় ধরনের প্রভাব পড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তা সত্ত্বেও, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে দেশীয় পণ্য কেনা এবং মার্কিন পণ্য বর্জনের আহ্বান ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে। এই পরিস্থিতি রপ্তানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে এবং দিল্লি-ওয়াশিংটন সম্পর্কে উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
এই বিষয়ে রয়টার্সের পক্ষ থেকে ম্যাকডোনাল্ডস, কোকাকোলা, অ্যামাজন ও অ্যাপলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াও স্কিন সায়েন্স’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মনীষ চৌধুরী লিংকডইনে এক ভিডিও বার্তায় দেশের কৃষক ও স্টার্টআপগুলোকে সমর্থনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমাদের ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ পণ্যকে বিশ্বজুড়ে এক আবেগের জায়গায় পরিণত করতে হবে।”
দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ টেনে তিনি দেখান, কীভাবে দেশটির খাদ্য ও সৌন্দর্য পণ্য বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
মনীষ আরও বলেন, ‘আমরা হাজার হাজার মাইল দূরের পণ্যের জন্য লাইন ধরেছি এবং বিদেশি ব্র্যান্ডের পেছনে গর্ব করে অর্থ খরচ করেছি, অথচ আমাদের দেশের উৎপাদকরা নিজের দেশেই মনোযোগ পাওয়ার জন্য লড়াই করছেন।’
একইভাবে, ভারতের ড্রাইভার পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘ড্রাইভ ইউ’-এর সিইও রাহম শাস্ত্রী লিংকডইনে লিখেছেন, ‘চীনের মতো ভারতেরও নিজস্ব টুইটার, গুগল, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক থাকা উচিত।’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি বেঙ্গালুরুতে এক সমাবেশে নাগরিকদের ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বিশ্বের জন্য পণ্য তৈরি করে, কিন্তু এখন ভারতের নিজস্ব প্রয়োজনকে আরও বেশি অগ্রাধিকার দেওয়ার সময় এসেছে। তবে তার বক্তৃতায় তিনি কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির নাম উল্লেখ করেননি।
নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমর্থক সংগঠন ‘স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ’ দেশজুড়ে ছোট ছোট জনসভা করে মার্কিন ব্র্যান্ড বয়কটের ডাক দিয়েছে। সংগঠনটির সহ-সমন্বয়ক অশ্বিনী মহাজন এই আন্দোলনকে ‘জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের ডাক’ বলে অভিহিত করেছেন। তারা হোয়াটসঅ্যাপে ভারতীয় পণ্যের একটি তালিকা প্রচার করছে, যেখানে বিদেশি পণ্যের বিকল্প হিসেবে দেশীয় ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ রয়েছে।
তবে সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে এই বয়কটের ডাক নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। উত্তর প্রদেশের লখনউতে ম্যাকডোনাল্ডসে কফি পান করতে আসা ৩৭ বছর বয়সি রজত গুপ্তা বলেন, তিনি শুল্ক বৃদ্ধির প্রতিবাদ নিয়ে উদ্বিগ্ন নন এবং ৪৯ রুপির কফিকে সাশ্রয়ী বলেই মনে করেন। তার মতে, ‘শুল্ক কূটনীতির বিষয়, আমার ম্যাকপাফ আর কফিকে এর মধ্যে টেনে আনা উচিত নয়।’
এই প্রতিবাদ সত্ত্বেও, মার্কিন বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা টেসলা সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে তাদের দ্বিতীয় শোরুম উদ্বোধন করেছে, যেখানে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
সব মিলিয়ে, মার্কিন শুল্কারোপের বিরুদ্ধে ভারতে জাতীয়তাবাদী আবেগ বাড়লেও আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলোর জনপ্রিয়তা এবং দৈনন্দিন জীবনে সেগুলোর প্রভাব এখনো বেশ শক্তিশালী। এই বয়কটের ডাক দীর্ঘমেয়াদে কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলে দেবে।