সম্প্রতি আসাম, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ এলাকায় তিনটি নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে ভারত। যা শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেককে সুরক্ষায় একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভারতের এই কৌশলগত পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা মানচিত্রে একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কৌশলগত প্রেক্ষাপট
শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। যা মাত্র প্রায় ২২ কিলোমিটার চওড়া একটি সংকীর্ণ এলাকা। এই এলাকায় ভারত তার বিমান ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা সম্প্রসারিত করেছে। এখানে রাফেল যুদ্ধবিমানের স্কোয়াড্রন, ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র, এবং এস‑৪০০ ও অন্যান্য স্তরের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করেছে দেশটি।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ভূমি পথটি শুধুমাত্র লজিস্টিক কনডাক্টর নয়। বরং এক কৌশলগত ‘নজরদারি ও প্রতিরক্ষা হালের’ দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি চীনের সহায়তায় লালমনিরহাটে পরিত্যক্ত বিমানবন্দর পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। বিমানবন্দরটি পুনরায় চালু হলে, এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটাতে পারে। আর এই খবর চাউর হওয়ার পরই নড়েচড়ে বসেছে নিকট প্রতিবেশী ভারত। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লালমনিরহাট বিমানবন্দর ভারতের সীমান্ত থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে এবং কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ‘সিলিগুড়ি করিডর’ বা ‘চিকেনস নেক’-এর খুব কাছাকাছি অবস্থিত। ফলে বাংলাদেশের এমন উদ্যোগে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে ভারত সরকার।
ভারত আশঙ্কা করছে, লালমনিরহাট বিমানবন্দর চালুর পেছনে চীনের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। ভবিষ্যতে সেখানে সামরিক অবকাঠামো—যেমন ফাইটার জেট, রাডার ও নজরদারি সরঞ্জাম স্থাপনের সুযোগ তৈরি হতে পারে, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। বিমানবন্দর চালু হলে সেখানে আন্তর্জাতিক যাত্রী ও কার্গো চলাচল শুরু হবে, যা ভারতের জন্য সীমান্ত নজরদারি ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ বাড়াতে পারে। পাশাপাশি লালমনিরহাট বিমানবন্দর নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে আঞ্চলিক ট্রানজিট হাবে পরিণত হয়ে উঠতে পারে। এতে বাংলাদেশের আঞ্চলিক প্রভাব বাড়বে, যা ইতি ঘটাবে ভারতের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের।

বাংলাদেশের এই পদক্ষেপের খবর প্রকাশের পরপরই পাল্টা উদ্যোগ নিচ্ছে ভারত সরকার। ত্রিপুরা রাজ্যের তিন দশক ধরে পরিত্যক্ত কৈলাশহর বিমানবন্দর পুনরায় চালু করার তোড়জোড় শুরু করেছে দেশটি। ইতোমধ্যে ত্রিপুরা সরকারের পরিবহন মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বিমানবন্দরটি পরিদর্শন করেছেন। অ্যালায়েন্স এয়ার এবং স্পিরিট এয়ার নামক দুটি বেসরকারি বিমান সংস্থা কৈলাশহর বিমানবন্দর থেকে ছোট আকারের বিমান পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে অপারেশনাল পরিকল্পনা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। প্রথম পর্যায়ে, বিদ্যমান অবকাঠামোর সংস্কার করে কৈলাশহর থেকে আগরতলা ও কলকাতার মধ্যে ছোট বিমানের চলাচল শুরু করার লক্ষ্য রয়েছে।
এটি শুধুই কৌশলগত পরিকল্পনা?
প্রতিটি দৃষ্টিকোণ থেকেই ভারতের এই পদক্ষেপকে কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ বলে দেখা হচ্ছে। যেসব এলাকা (চিকেন‑নেক) ভারতকে সংযুক্ত রাখে তার সরাসরি নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা মানে কেবল সামরিক প্রতিকারই নয়, এর দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত গুরুত্বও রয়েছে। রাফেল যুদ্ধবিমানের স্কোয়াড্রন, ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র, এবং এস‑৪০০ ও অন্যান্য স্তরের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েনের সিদ্ধান্তকে প্রতিকারমূলক প্রতিরক্ষা থেকে শক্তি প্রতিস্থাপনের দিকে নিয়ে যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের এই পদক্ষেপ কেবল প্রতিরক্ষাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে আঞ্চলিক আধিপত্য গড়ার পথে ভারতের স্ট্রাটেজি নির্দেশ করে। একই সঙ্গে স্থানীয় এবং সীমান্তবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনও ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে। বিশেষত বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘিরে কূটনৈতিক তৎপরতাকে ব্যালেন্স করার নতুন চ্যালেঞ্জ ভারতের সামনে।
নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যালান্স গড়ার চেষ্টা
ভারত এই ঘাঁটিগুলোকে ‘কৌশলগত কন্ট্রোল পয়েন্ট’ হিসেবে তৈরি করছে। যার অর্থ শুধু প্রতিরক্ষা না, বরং সীমান্ত ব্যালান্সে নিয়ন্ত্রণ গড়ার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে। যদি চীন বা অন্য পক্ষ বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে প্রভাব বাড়ায়, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া জানাতে সীমান্তে নিজের আধিপত্যের জানান দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত। যা দেশটির প্রতিহতকারী কৌশল থেকে ডোমিন্যান্স কৌশলের দিকে নির্দেশ করতে পারে।
ঝুঁকি ও সীমাবদ্ধতা
যদিও এই ঘাঁটি গড়ার সিদ্ধান্ত একটি বড় পদক্ষেপ, কিন্তু ভারতকে এই প্রস্তুতির ব্যয়-রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এছাড়া, সীমান্তে এমন শক্তিশালী অস্ত্র এবং ঘাঁটি গড়লে তাত্ক্ষণিক বিপদ কমতে পারে। কিন্তু নিরাপত্তা দৃষ্টিকোণ থেকে দীর্ঘমেয়াদে অন্যান্য প্রতিক্রিয়া (কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া, প্রতিপক্ষ শক্তি উত্তেজনা) তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ বা চীন যদি এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে ভারতের সীমান্তে প্রতিরক্ষা গড়ার এই কৌশলকে আরও জটিলতা এবং ঝুঁকির সঙ্গে মোকাবিলা করতে হতে পারে।


সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন