ঢাকা রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন

গাজায় নিহত ফিলিস্তিনিদের ৮৩ শতাংশই বেসামরিক মানুষ

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৫, ০২:৫০ পিএম
গাজায় ধ্বংসস্তুপের মধ্যে উড্ডয়মান ফিলিস্তিনের পতাকা। ছবি- সংগৃহীত

ফিলিস্তিনের গাজায়  ইসরায়েলি হামলায় নিহত ছয় জনের মধ্যে পাঁচজনই বেসামরিক মানুষ। ইসরায়েলের ‘‍+৯৭২ ম্যাগাজিন’–এর হিব্রু ভাষার সহযোগী প্রকাশনা ‘লোকাল কল’ ও প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান যৌথভাবে ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

এতে বলা হয়, এ বছরের মে মাস পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গোপন গোয়েন্দা তথ্যভান্ডারে নাম-পরিচয়সহ ৮ হাজার ৯০০ জন হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) যোদ্ধাকে নিহত বা ‘সম্ভাব্য নিহত’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ওই সময় গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৩ হাজার। এ হিসাব অনুযায়ী, নিহত ফিলিস্তিনিদের মাত্র ১৭ শতাংশ যোদ্ধা ও বাকি ৮৩ শতাংশই বেসামরিক মানুষ।

+৯৭২ ম্যাগাজিন ও লোকাল কল এ বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা এ তথ্যভান্ডারের অস্তিত্ব কিংবা নিহত হামাস ও পিআইজে সদস্যদের সংখ্যার ব্যাপারে আপত্তি জানায়নি। পরে দ্য গার্ডিয়ান একই বিষয়ে প্রশ্ন করলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ভিন্ন সুরে কথা বলে। সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেন, প্রতিবেদনে যে সংখ্যাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। তবে কোন তথ্য ভুল, তা স্পষ্ট করেননি তিনি। শুধু বলেছেন, সংখ্যাগুলো সেনাবাহিনীর ‘সিস্টেমে’ থাকা তথ্যের প্রতিফলন নয়। একই তথ্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গণমাধ্যমকে ভিন্ন উত্তর দেওয়ার কারণও সেনাবাহিনী ব্যাখ্যা করেনি।

ইসরায়েলি তথ্যভান্ডারে মোট ৪৭ হাজার ৬৫৩ জন ফিলিস্তিনির নাম রয়েছে। তাঁদের হামাস ও পিআইজের সক্রিয় সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। এ তথ্যে তারা বলছে, গাজা থেকে উদ্ধার করা হামাস ও পিআইজের অভ্যন্তরীণ নথির ভিত্তিতে। তবে এসব নথি দ্য গার্ডিয়ান, ‍+৯৭২ ম্যাগাজিন বা লোকাল কল—কোনোটিই দেখতে পায়নি বা যাচাই করতে পারেনি। 

তালিকায় ৩৪ হাজার ৯৭৩ হামাস সদস্য ও ১২ হাজার ৭০২ জন পিআইজে সদস্যের নাম রয়েছে। এর মধ্যে নিহত হিসেবে ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯০০ জনকে। নিশ্চিতভাবে নিহত বলা হয়েছে ৭ হাজার ৩৩০ জনকে, আর ১ হাজার ৫৭০ জনকে ধরা হয়েছে ‘সম্ভাব্য নিহত’ হিসেবে। তবে নিহত এই ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ছিলেন সংগঠন দুটির নিচের স্তরের সদস্য। তথ্যভান্ডারে থাকা ৭৫০ শীর্ষস্থানীয় সদস্যের মধ্যে মাত্র ১০০ থেকে ৩০০ জন নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

লোকাল কলের আগের প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যাকে ইসরায়েলও নির্ভরযোগ্য বলে ধরে নেয়। দেশটির সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধানও সম্প্রতি সেই হিসাব উদ্ধৃত করেছেন।

তবে নতুন তদন্ত বলছে, বেসামরিক ফিলিস্তিনি হতাহত হওয়ার হার হয়তো ৮৩ শতাংশের বেশি। কারণ, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব শুধু উদ্ধার হওয়া মৃতদেহের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ভবন বা অন্যান্য স্থাপনার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া হাজারো লাশ এতে অন্তর্ভুক্ত নেই।

আরেকটি বিষয় হলো ইসরায়েলি গোয়েন্দারা তাঁদের তালিকায় অনেক বেসামরিক মানুষকেও যোদ্ধা হিসেবে দেখাতে পারেন—শুধু হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে। এর মধ্যে পুলিশ সদস্য বা গাজার প্রশাসনিক কাজে যুক্ত ব্যক্তিরাও থাকতে পারেন, যাঁদের আন্তর্জাতিক আইনে যোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা যায় না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এমনও হতে পারে, অনেক ফিলিস্তিনি, যাঁদের হামাস বা পিআইজের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই, তাঁদেরও যোদ্ধা হিসেবে দেখানো হয়েছে। একটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে যে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ড তার সেনাদের অনুমতি দিয়েছে, তাঁরা চাইলে যাচাই-বাছাই ছাড়াই নিহত ফিলিস্তিনিদের যোদ্ধা হিসেবে রিপোর্ট করতে পারেন।

এদিকে মে মাসের পর থেকে গাজায় বেসামরিক মানুষের নিহত হওয়ার হার আরও বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই মাসেই আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার পরিবর্তে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত বিতর্কিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ত্রাণ বিতরণ শুরু করে। এর পর থেকে শুধু ত্রাণ নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

আধুনিককালের যুদ্ধেও বিরল

প্রতিবেদনে বলা হয়, আধুনিককালের যুদ্ধে এভাবে ৮৩ শতাংশ বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা বিরল। এমনকি সিরিয়া ও সুদানের দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধেও এ হার এত বেশি ছিল না। দ্য গার্ডিয়ানের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালের পর থেকে স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যা, রুয়ান্ডার গণহত্যা ও ইউক্রেনের মারিউপোলে রাশিয়ার অবরোধ ছাড়া অন্য কোনো সংঘাতে বেসামরিক মানুষের এত বেশি মৃত্যু আর দেখা যায়নি।

গণহত্যার অভিযোগ

শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থাগুলো গাজায় ইসরায়েলের হত্যাকাণ্ডকে সরাসরি গণহত্যা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংস্থা হিসেবে জানায়, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ আসলে গণহত্যা। এরপর একই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ও ইসরায়েলের নিজস্ব মানবাধিকার সংস্থা বেতসেলেম। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সেসকা আলবানিজও গত বছর দুটি প্রতিবেদনে বলেছেন, গাজায় গণহত্যা চলছে। গত মাসে হলোকাস্ট ও গণহত্যা নিয়ে গবেষণায় খ্যাতি পাওয়া অধ্যাপক ওমর বার্তভ গাজার যুদ্ধকে ‘অবশ্যম্ভাবীভাবে গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতো আরও অনেক খ্যাতিমান ইসরায়েলি ও ইহুদি গবেষক পৌঁছেছেন একই সিদ্ধান্তে।