ঢাকা বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

কী চলছে আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৫, ০১:৫০ পিএম
আফগানিস্তান ও পাকিস্তান-এর প্রধান। ছবি - সংগৃহীত

আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সীমান্ত উত্তেজনা ভয়াবহ সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। আজ বুধবার (১৫ অক্টোবর) ভোরে পাকিস্তান আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশের স্পিন বোলদাক এলাকায় বিমান ও ড্রোন হামলা চালায়। তালেবান প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী, এই হামলায় অন্তত ২০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ১০০ জনের বেশি আহত হয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান জানিয়েছে, তালেবান বাহিনীর হামলায় তাদের ২৩ সেনা নিহত হয়েছে। তালেবান পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা ৫৮ জন পাকিস্তানি সেনা হত্যা করেছে এবং একাধিক সামরিক পোস্ট দখল করেছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান থেকে চালানো বিমান ও ড্রোন হামলায় স্পিন বোলদাকের তালেবান পোস্টগুলোতে আঘাত হানে। এছাড়া আফগান-তালেবান বাহিনীর কমপক্ষে থেকে পাকিস্তানের তিনটি পোস্টে চারানো হয়।

তালেবান বাহিনী জানিয়েছেন, ভোরবেলা তারা আকাশে ড্রোন ও যুদ্ধবিমান দেখতে পান এবং কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনেন। বিমান হামলার পরপরই সীমান্তজুড়ে তীব্র গুলিবিনিময় শুরু হয়, যা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলে।

খামা প্রেসসহ আফগান গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, পাকিস্তানি বাহিনী আবাসিক এলাকাগুলোতেও গোলাবর্ষণ করে, এর ফলে বহু বেসামরিক মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।

স্পিন বোলদাকের তথ্য কর্মকর্তা আলি মোহাম্মদ হকমাল জানান, ‘সংঘর্ষে হালকা এবং ভারী উভয় ধরণের অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে।

এদিকে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ এক্স (সাবেক টুইটার)–এ দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় ১২ জনের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে শতাধিক।

তিনি আরও দাবি করেন, ‘তালেবান বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের একাধিক পোস্ট দখল করেছে এবং বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম জব্দ ও ধ্বংস করেছে।’

অন্যদিকে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তালেবানকেই এই সংঘর্ষের জন্য দায়ী করেছে। বেলুচিস্তানের চামান জেলার আঞ্চলিক প্রশাসক হাবিব উল্লাহ বাঙ্গুলজাই জানান, ‘তালেবান বাহিনী চামান সংলগ্ন একটি পাকিস্তানি সামরিক পোস্টে প্রথমে আক্রমণ চালায়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলা এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে বলে তিনি জানান। পাকিস্তানি ভূখণ্ডে এ সময় চারজন বেসামরিক নাগরিক আহত হন।

সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, ১১ অক্টোবর রাতে আফগান বাহিনী একাধিক পাকিস্তানি সামরিক পোস্টে হামলা চালায়। আফগান কর্মকর্তারা দাবি করেন, এটি ছিল পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আফগান ভূখণ্ড ও আকাশসীমা বারবার লঙ্ঘনের জবাবে প্রতিশোধ।

তালেবান বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ওই হামলায় ৫৮ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। তবে পাকিস্তান এই দাবি অস্বীকার করে জানায়, তারা ২৩ জন সেনা হারিয়েছে এবং পাল্টা গুলিবর্ষণে প্রায় ২০০ জন তালেবান এবং সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে।

সংঘর্ষের কারণে চামান-স্পিন বোলদাকসহ প্রধান সীমান্ত ক্রসিংগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে এবং সীমান্তে আটকে পড়েছে শত শত ট্রাক।

গত লোববার থেকে সীমান্তে আটকে থাকা প্রায় ১,৫০০ আফগান নাগরিককে পায়ে হেঁটে দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়া হলেও সামগ্রিক পরিস্থিতি এখনো অস্থিতিশীল। পাকিস্তান আফগানিস্তানের অন্যতম প্রধান খাদ্য ও পণ্য সরবরাহকারী দেশ হওয়ায় এই অবরোধ আফগান জনগণের জন্য আরও সংকট তৈরি করছে।

পাকিস্তানের শীর্ষ গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, দেশের পশ্চিম সীমান্তে এখন আফগান তালেবান এবং তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর একযোগে হামলায় পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক চাপে রয়েছে।

স্পিন বোলদাক সীমান্তে তালেবানদের ভারী গোলাবর্ষণ এবং নির্ভুল হামলার ফলে পাকিস্তানের সামরিক অগ্রবর্তী অবস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফিল্ড যোগাযোগ ও ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কও, যা সেনা ইউনিটগুলোর মধ্যে সমন্বয় ব্যাহত করছে।

বেলুচিস্তানের চামান এবং আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশের মধ্যকার ‘ফ্রেন্ডশিপ গেট’ নামক গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত গেটটিও গুলিবর্ষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাকিস্তানি ভূখণ্ডে একটি বাড়িতে বিক্ষিপ্ত গুলি লাগলে এক তরুণী আহত হন, যা সীমান্তে বেসামরিক ঝুঁকির মাত্রা স্পষ্ট করে তোলে।

এদিকে খাইবার পাখতুনখোয়া ও ওরাকজাইসহ উপজাতীয় অঞ্চলে টিটিপির গেরিলা হামলা ও আইইডি বিস্ফোরণ বেড়ে গেছে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, কিছু পাকিস্তানি সামরিক পোস্ট তালেবান হামলার মুখে দখল হয়ে গেছে কিংবা সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত হয়েছে। ফলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এখন ভেতর ও বাইরের দ্বিমুখী চাপে রয়েছে।

এই অবস্থায় পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির সেনা সদর দপ্তর GHQ রাওয়ালপিন্ডিতে শীর্ষ জেনারেলদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। তিনি ফিল্ড কমান্ডারদের তিরস্কার করে বলেন, তালেবান আক্রমণের মাত্রা ও সময় অনুমান করতে ব্যর্থ হওয়াই এই পরিস্থিতির কারণ। গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতির কথাও উঠে এসেছে বৈঠকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংঘাত পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংকটকে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। আফগান তালেবান বাহিনী সীমান্তে আধিপত্য বিস্তার করছে এবং টিটিপি বিদ্রোহীরা দেশের অভ্যন্তরে হামলা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এখন দ্বিমুখী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, যা তার সামরিক সক্ষমতার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।