ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অন্তত এক লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়ে থাকতে পারে। এমনটাই উঠে এসেছে জার্মানির শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি নতুন গবেষণায়। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউট ফর ডেমোগ্রাফিক রিসার্চ (এমপিআইডিআর) এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গবেষণা বলছে, ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত নিহতের সংখ্যার চেয়ে গাজায় প্রকৃত নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যা-গবেষণা প্রতিষ্ঠান এমপিআইডিআর তাদের পরিসংখ্যানে বিভিন্ন উন্মুক্ত সূত্র ব্যবহার করেছে; এর মধ্যে রয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বেৎসলেম, জাতিসংঘের দুটি সংস্থা এবং ফিলিস্তিনি কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো। প্রতিবেদনে হিসাব দেওয়া হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত গাজায় সরাসরি যুদ্ধজনিত সহিংসতায় ৭৮ হাজার ৩১৮ জন নিহত হন। পরবর্তী বিশ্লেষণে গবেষকেরা দেখেন, ২০২৫ সালের ৬ অক্টোবরের মধ্যেই এই সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৬৯ হাজার ৭৩৩ জন ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছে। কিন্তু এমপিআইডিআর-এর গবেষণা বলছে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, যুদ্ধের প্রভাবে ২০২৩ সালে গাজার মানুষের গড় আয়ু ৪৪ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে ৪৭ শতাংশ কমে যায়।
যুদ্ধ না হলে যে গড় আয়ু হওয়ার কথা ছিল, তার তুলনায় ৩৪ দশমিক ৪ এবং ৩৬ দশমিক ৪ বছরের ক্ষতি হয়েছে। ২০২৪ সালের শেষে ফিলিস্তিনের জিডিপি ২০১০ সালের স্তরে নেমে এসেছে, আর মাথাপিছু জিডিপি ফিরে গেছে ২০০৩ সালের অবস্থায়। অর্থাৎ দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ২২ বছরের উন্নয়ন অগ্রগতি বিলীন হয়েছে। ইসরায়েলের হামলায় গাজা উপত্যকা ‘মানবসৃষ্ট নরকে’ পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা জানিয়েছে, অঞ্চলটি পুনর্গঠন করতে কয়েক দশকে ৭০ বিলিয়ন ডলারেরও (৫৩ বিলিয়ন পাউন্ড) বেশি খরচ হতে পারে। খবর দ্য গার্ডিয়ান। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে চরমভাবে ‘বহুস্তরীয় দারিদ্র্যের শিকার’ হয়েছে অন্তত ২৩ লাখ মানুষ। বাসিন্দাদের ‘টিকে থাকার প্রতিটি স্তম্ভকে গভীরভাবে দুর্বল করে দিয়েছে’ এ যুদ্ধ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ সময়কালে গাজার অর্থনীতি ৮৭ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে। ফলে মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ১৬১ ডলারে নেমে এসেছে। শুধু গাজা উপত্যকা নয়, দ্রুতগতিতে বসতি সম্প্রসারণ ও শ্রমিকদের চলাচলে বিধি-নিষেধের ফলে ধ্বংস হয়েছে পশ্চিম তীরের অর্থনীতিও। রাজস্বের পতন ও ইসরায়েলি সরকারের অর্থ স্থানান্তর আটকে দেওয়ার ফলে প্রয়োজনীয় সরকারি সেবা দিতে পারছে না ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগ করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
রেকর্ড পর্যায়ের অর্থনৈতিক সঙ্কোচন পশ্চিম তীর ও গাজায় বহু দশকের অগ্রগতিকে ধীর করে দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের শেষে ফিলিস্তিনের জিডিপি ২০১০ সালের স্তরে নেমে এসেছে, আর মাথাপিছু জিডিপি ফিরে গেছে ২০০৩ সালের অবস্থায়। অর্থাৎ দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ২২ বছরের উন্নয়ন অগ্রগতি বিলীন হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যাপক আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়া গেলেও ২০২৩ সালের অক্টোবর-পূর্ববর্তী অর্থনৈতিক অবস্থায় ফিরতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত গাজা শান্তি পরিকল্পনার ২০ দফার তাৎক্ষণিক শর্তগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন তো আরও অনিশ্চিত। তবে গত সপ্তাহে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত গাজা পরিকল্পনাকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন দিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। এতে গাজায় একটি অন্তর্বর্তী টেকনোক্র্যাট ফিলিস্তিনি সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। যার তত্ত্বাবধান করবে একটি আন্তর্জাতিক ‘শান্তি বোর্ড’ আর এতে সমর্থন দেবে একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার অধিকাংশ পরিবারই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে সক্ষম নয়। গাজার মানুষের খাদ্যতালিকা এখন মূলত শস্য, ডাল, সামান্য দুগ্ধজাত পণ্য ও তেলে সীমাবদ্ধ। মাংস, সবজি ও ফল প্রায় অনুপস্থিত। রান্নার গ্যাসের ঘাটতি তীব্র হওয়ায় বহু পরিবার প্লাস্টিকের বর্জ্যসহ বিকল্প জ্বালানিতে খাবার রান্না করতে বাধ্য হচ্ছে।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় দুই বছরের যুদ্ধে ইসরায়েল কমপক্ষে ৩৩ হাজার নারী ও শিশুকে হত্যা করেছে। এমনই অভিযোগ করেছে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসে দেওয়া এক বিবৃতিতে তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও পরিকল্পিত অত্যাচারের অভিযোগও তুলেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, গাজা সরকারের মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ১২ হাজার ৫০০ নারী এবং ২০ হাজার শিশুকে হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে ইসরায়েল। মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ, ইসরায়েল ফিলিস্তিনি নারীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগতভাবে গণহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক গুম, নির্বিচার আটক, নির্যাতন, যৌন সহিংসতা, ঘরবাড়ি ধ্বংস, জমি দখল, দখলদারদের সন্ত্রাস, খাদ্য সংকট সৃষ্টি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মতো অপরাধ চালাচ্ছে।
তারা আরও অভিযোগ করে, ফিলিস্তিনিদের বিশেষ করে নারীদের লক্ষ্যবস্তু বানাতে ইসরায়েল উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার গুপ্তচর প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের বেআইনি দখলদারি বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ বজায় রাখা, দ্বিরাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়ন এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধীনতা ও অবাধ প্রত্যাবর্তনের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি বলে বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলা হয়। গাজায় টানা দুই বছরের ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন এক লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি। নিহতদের প্রায় ২৭ শতাংশই ১৫ বছরের কম বয়সি শিশু এবং প্রায় ২৪ শতাংশ নারী। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের নতুন গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই বছরের ইসরায়েলি আগ্রাসনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পুরো গাজা উপত্যকা। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, এরই মধ্যে ৬৯ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।
তবে প্রাণহানির এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট। গবেষণা প্রকল্পের কো-লিডার ইরিনা চেন জানান, বাস্তব পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সঠিক মৃতের সংখ্যা নিরূপণের চেষ্টা চলছে। সরকারি হিসাবের বাইরে বিপুল মৃত্যু নথিভুক্ত না হওয়ায় প্রকৃত চিত্র আরও বড় হতে পারে বলেও দাবি তাঁর। গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধের প্রথম দুই বছরে গাজায় নিহতের সংখ্যা ৯৯ হাজার ৯৯৭ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার ৯১৫-এর মধ্যে। গড় হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার ৬৯ জন। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক গবেষক দল বিভিন্ন উৎসের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যের পাশাপাশি স্বাধীন পরিবারভিত্তিক সমীক্ষা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত মৃত্যুসংবাদও বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বয়স ও লিঙ্গভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী, নিহতদের প্রায় ২৭ শতাংশই ১৫ বছরের কম বয়সি শিশু এবং প্রায় ২৪ শতাংশ নারী। গবেষকদের ব্যাখ্যা, নারী ও বয়স্কদের মৃত্যুর তথ্য অনেক সময় আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত হয় না।

