২০১৪ সালে ব্যাংক এশিয়ার মাধ্যমে সীমিত আকারে চালু হওয়া এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা প্রথম ১০ বছরে দেশজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো এই সেবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তাতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে এজেন্ট ব্যাংকিং। এখন এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার গতি কিছুটা কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ছয় মাস ধরে এই সেবায় এজেন্ট ও আউটলেট কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ, নতুন যে পরিমাণ এজেন্ট ও আউটলেট হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি বন্ধ হয়ে গেছে। এই সেবায় আমানত বাড়লেও ঋণ তেমন বাড়ছে না। ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার গতি কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি দেশের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার আওতায় প্রায় আড়াই কোটি গ্রাহক হিসাব খোলা হয়েছে। দেশজুড়ে ২১ হাজার কেন্দ্রের মাধ্যমে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে। এজেন্টদের মাধ্যমে টাকা জমা দেওয়া, ঋণ নেওয়া, পরিষেবা বিল পরিশোধ, প্রবাসী আয় গ্রহণসহ নানা ধরনের সেবা প্রদান করা হয়। গত মে মাস পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার আওতায় আমানত জমা হয়েছে ৪৫ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। তার বিপরীতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আমানত সংগ্রহ করতে অনেক ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা বেছে নিয়েছে। এই সেবার মাধ্যমে কোনো কোনো ব্যাংক গ্রাম থেকে আমানত সংগ্রহ করে করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৩১টি ব্যাংক এই সেবার সঙ্গে যুক্ত। ২০২৪ সালের জুনে দেশজুড়ে এসব ব্যাংকের এজেন্ট ছিল ১৫ হাজার ৯৯১টি, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে ১৬ হাজার ২৬টিতে উন্নীত হয়। কিন্তু গত ডিসেম্বরে এজেন্টের সংখ্যা কমে হয় ১৬ হাজার ১৯। আর চলতি বছরের মে মাসে সংখ্যাটি আরও কমে হয় ১৫ হাজার ৮৯৮। সেই হিসাবে গত সেপ্টেম্বর থেকে মে পর্যন্ত আট মাসে এজেন্টের সংখ্যা কমেছে ১২৮। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি এজেন্টের এক বা একাধিক আউটলেট থাকতে পারে। গত বছরের জুনে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় আউটলেট ছিল ২১ হাজার ৪৭৩টি, যা মে মাসে কমে হয় ২১ হাজার ৮০টি। অর্থাৎ, ১১ মাসে এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা ৩৯৩টি কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিটি এজেন্টের একটি চলতি হিসাব থাকতে হয়। এই সেবার মাধ্যমে অর্থ জমা ও উত্তোলন করা যায়। পাশাপাশি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স স্থানীয় মুদ্রায় বিতরণ, ছোট অঙ্কের ঋণ প্রদান ও আদায় এবং এককালীন জমার কাজও করে এজেন্টরা। তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধের পাশাপাশি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর অর্থও উত্তোলন করা যায়। এ ছাড়া নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণ আবেদন, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের নথিপত্র সংগ্রহ করতে পারে এজেন্টরা। ব্যাংকের শাখার মতো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) সুপরিসর ও ছিমছাম কক্ষ ব্যবহার না করে এজেন্টরা নিজেদের ছোট দোকানঘরেও এই সেবা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এজেন্ট আউটলেটে দেশে শীর্ষে আছে ডাচ্বাংলা ব্যাংক। গত মে মাসের শেষে তাদের এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৬২০। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ব্যাংক এশিয়া। মে মাস শেষে দেশজুড়ে তাদের এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৩৫। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। তাদের এজেন্ট আউটলেট ২ হাজার ৭৯০। চতুর্থ অবস্থানে থাকা ব্র্যাক ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা ১ হাজার ১২৪। আর একই সময়ে পঞ্চম অবস্থানে থাকা মধুমতি ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা ৬৪৩।
ব্যাংকাররা বলছেন, এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা একবারে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় আমানত সংগ্রহ করা সহজ হয়েছে। মে মাস শেষে এই সেবায় আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা।
গত বছরের ডিসেম্বরে আমানত ছিল ৪১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। গত বছরের জুন ও সেপ্টেম্বর শেষে আমানত ছিল যথাক্রমে ৩৯ হাজার ৮১৩ কোটি ও ৩৯ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আমানত কমতে শুরু করেছিল, যা পরে আবার বাড়ে। মূলত ইসলামি ধারাসহ মোট ১৪ বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা ও কিছু ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় অনেকে আমানত তুলে নেন।
একাধিক ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রতি প্রান্তিকে যে পরিমাণ আমানত বেড়েছে, ঋণ ততটা বাড়েনি। তারল্যসংকট ও বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তনের ফলে এসব ব্যাংক ঋণ বিতরণে লাগাম টানে, যার প্রভাব পড়েছে এজেন্ট ব্যাংকিং ঋণে।
আপনার মতামত লিখুন :