- সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া
- আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা ওঠার সম্ভাবনা নেইÑ জানিয়েছে সরকার
- নানা ইস্যুতে ভিন্নমত থাকলেও আওয়ামী লীগ ঠেকাতে একমত রাজনৈতিক দলগুলো
আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা যেকোনো সময় তুলে নেওয়া হতে পারেÑ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তার এমন বক্তব্যের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। যদিও প্রধান উপদেষ্টা বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া স্বাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, তাদের নিবন্ধনও স্থগিত করা হয়নি। শুধু দলের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে।’ যদিও পরে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আপাতত আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে সচল করার কোনো সম্ভাবনা নেই। এদিকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতারা বলছেন, ’২৪-এর গণহত্যার নেতৃত্ব দেওয়া এবং বিগত সাড়ে ১৫ বছর দেশে স্বৈরশাসন চালানো আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। নিজেদের মধ্যে নানা ইস্যুতে ভিন্নমত বা পাল্টাপাল্টি অবস্থান থাকলেও আওয়ামী লীগ ঠেকানোর বিষয়ে তারা একমত। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরে বিএনপি মহাসচিব ও এনসিপির দুই নেতাকে হেনস্তার চেষ্টার পর এবং ঢাকায় দলটির নেতাকর্র্মীদের ধীরে ধীরে সংগঠিত হয়ে সহিংসতার অপচেষ্টা একসঙ্গে মোকাবিলা করবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র সফরে বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘কার্যক্রম স্থগিত থাকায় আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করতে পারবে না। তারা দল হিসেবে বৈধ রয়েছে, তবে কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। যেকোনো সময় এ কার্যক্রম আবার চালু করা হতে পারে।’ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিয়ে কেন এমন বক্তব্য দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা, সেটি বাঁকা চোখে দেখছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। প্রধান উপদেষ্টার এমন সাক্ষাৎকার গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এমন মন্তব্যের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কেউ কেউ করেছেন তীব্র ভাষায় সমালোচনাও।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া বক্তব্য জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আওয়ামী লীগ গণহত্যাকারী দল, তারা গণদুশমন। যারা গুম করেছে, মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে, দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে নিয়ে নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে; তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচার ও ক্ষমা চাওয়া ছাড়া দলটির বিষয়ে কারও ব্যক্তিগতভাবে কিছু করার আছে বলে মনে করে না দলগুলো। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে এ ধরনের সিদ্ধান্ত হলে নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত বা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিলে ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, তা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে। এমনকি নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে বলেও মনে করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কোনো চিন্তা তাদের নেই। নিষেধাজ্ঞা যেটা আছে, সেটাই থাকবে। গত বুধবার আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বরিশালে পুজাম-প পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, আপাতত আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রেস সচিবও বলেছেন, সরকার ঠিক এভাবে বলেনি কথাটা। অবশ্য সাক্ষাৎকারে ‘আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা যেকোনো সময় তুলে নেওয়া হতে পারে’Ñ এমন কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেননি বলে জানিয়েছে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) পরিচালিত ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান বাংলাফ্যাক্ট।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী যে ঐক্য গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে, সেটি কিন্তু বিনষ্ট হয়নি। পতিত স্বৈরাচার বাংলাদেশে আর ফিরে আসতে পারবে না। দেশের মানুষই আসতে দেবে না। মানুষ তাদের দুঃশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে। মুখ ফুটে কষ্টের কথা বলতে পারেনি। কষ্ট হলে ঘরে বসে কাঁদত, তবু বলার সাহস পেত না। এখন তো মানুষ মন খুলে কথা বলছে। সরকারের সমালোচনা করছে। বিএনপির কেউ অপরাধে জড়ালে ফলাও করে প্রচার করছে। মানুষ এমনটাই চায়। কিন্তু একটি মহল পরিকল্পতভাবে রাজনীতিতে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে করে পলাতক ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার পথ তৈরি হতেই পারে। বিএনপির তো হারানোর কিছু নেই। যারা ক্ষমতায় যাওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখছে, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
আওয়ামী লীগ ইস্যুতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ ফ্যাসিবাদ আর কখনো মেনে নেবে না। আমরা সবাই ঐকমত্যের ভিত্তিতেই চলতে চাই। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সুযোগ করে দিতে নতুন নতুন তত্ত্ব সামনে আনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্য নানা দর্শনের আড়ালে আন্তর্জাতিক দরজা উন্মুক্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে ছাত্র-জনতার ত্যাগ ও কোরবানির বিনিময়ে অর্জিত সফলতা ধরে রাখতে হলে ফ্যাসিবাদীদের বিচার ও সংস্কার ত্বরান্বিত করতে হবে। ইতিবাচক ধারায় দেশের রাজনীতিকে নিয়ে যেতে এবং স্বৈরাচারের পুনর্বাসন ঠেকাতে সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মারা ঘাপটি মেরে আছে। দিল্লির আধিপত্যবাদের কালো থাবা সব দিক থেকে চেপে বসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক নীতি, কূটনীতির ওপর এর ছায়া বিস্তৃত হয়েছে। এমনকি আসন্ন নির্বাচন নিয়েও জনগণের আকাক্সক্ষা ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন চাই, তা হবে সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাংলাদেশের সরকার গঠন করতে চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংস্কার ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কোনো দল বিতর্ক করলেই তার মানে এ নয় যে, তারা নির্বাচন চায় না কিংবা নির্বাচন পেছাতে চায়। আলোচনার সময় মতপার্থক্য হতেই পারে, নতুন যুক্তি আসতেই পারে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের সহযোগী যত দোসর রয়েছে এবং যারা দলটিকে আবার পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে, তাদের সবাইকে দেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করা হবে। দেশের আদালতে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। এর বিকল্প নেই। আমরা আশা করব, দেশ যাতে অস্থিতিশীলতার জায়গায় না যায়। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকব। বাংলাদেশে সংস্কারও হবে, নির্বাচনও হবে, নতুন সংবিধানও হবে। এটা জনগণের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি। আমরা লক্ষ করছি, দেশে একধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারÑ ফ্যাসিবাদী পক্ষকে আমরা কোনোভাবেই জায়গা করে দেব না। সুযোগ করে দেব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান, দেশের এই পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কেউ পতিত কোনো শক্তিকে সহায়তা করবেন না, সমর্থন দেবেন না। তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। অনেক রক্তের বিনিময়ে, অনেক সংগ্রামের বিনিময়ে আমরা আজকের এই পরিস্থিতিতে এসেছি।’