সোমবার, ২৮ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মিজানুর রহমান মিজান, টেকনাফ (কক্সবাজার)

প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০২৫, ০১:৩৯ এএম

আরাকান আর্মির বাধায় বন্ধ টেকনাফ স্থলবন্দরের বাণিজ্য পচে যাচ্ছে পণ্য

মিজানুর রহমান মিজান, টেকনাফ (কক্সবাজার)

প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০২৫, ০১:৩৯ এএম

আরাকান আর্মির বাধায় বন্ধ  টেকনাফ স্থলবন্দরের বাণিজ্য পচে যাচ্ছে পণ্য

মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির বাধায় বন্ধ হয়ে গেছে টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। গোডাউনে জমে থাকা কোটি টাকার পণ্য পচে গলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এতে বিপাকে পড়েছে বন্দর ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও বন্দরসংশ্লিষ্ট অস্থায়ী দোকানপাট ব্যবসায়ীরা। এতে ভয়ংকরভাবে বেড়েছে চোরাচালান। ক্ষতি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সরকারি রাজস্ব। পিছিয়ে পড়ছে টেকনাফের অর্থনীতি।

দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ রয়েছে টেকনাফ শাহ্পরীর দ্বীপের পশু আমদানি করিডোর, সেন্টমার্টিনের পর্যটন ব্যবসা। এ ছাড়া আরাকান আর্মির দৌরাত্ম্যে আতঙ্কিত টেকনাফের জেলেরা নাফ নদ ও সাগরে মাছ শিকারে যেতে ভয় পাচ্ছেন।
সীমান্তের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, গত ৪ মাস ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। শত শত ট্রাকভর্তি রপ্তানিপণ্য বন্দর এলাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যা আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হচ্ছে। বন্দরের দেড় হাজারের মতো দৈনিক মজুরি শ্রমিক, ট্রাকচালক এবং নাবিকরা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের অনেকেই টেকনাফে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কার্যক্রম স্থানান্তর করছেন বলে জানা গেছে।

গত মার্চেই শুধু মিয়ানমার থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে ৬৭৫ দশমিক ৪৩ টন পণ্য আমদানি হয়। এতে সরকারের রাজস্ব আদায় হয় ৭ কোটি ৯৬ লাখ ৫ হাজার ২৬৫ টাকা। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রায় ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৫২৪ দশমিক ৫২ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। টনের হিসাবে যা ৩ হাজার ৪৫৫ দশমিক ৯৮৪ টন। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আলু, বিস্কুট, পানি ও প্লাস্টিকজাত পণ্য।

সূত্র জানায়, রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে শেষবার কাঠের নৌকা এসেছিল ১২ এপ্রিল। সেই থেকে টেকনাফ-মংডু সীমান্তে বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে।

নাফ নদ এবং স্থলভাগজুড়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে ২৭২ কিলোমিটার এলাকা। এই বিস্তীর্ণ সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান বন্ধ করে বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল অনেক আগে। ২০০৩ সালে টেকনাফ স্থলবন্দর চালু করেছিলেন তৎকালীন বিএনপি সরকার। ২০০৭ সাল থেকে পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেড।

বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বন্দর চালু হওয়ার পর থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকা করে রাজস্ব আয় হয়েছে। কমেছে চোরাচালান। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে যুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। চাঙ্গা হয়েছে সীমান্ত জনপদ টেকনাফের অর্থনীতি। আরাকান আর্মির বাধায় বন্দর বন্ধ থাকার পর হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর দিন পার করছেন এবং জড়িয়ে পড়ছেন মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে।
মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি আরাকান রাজ্য তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নানা অজুহাতে বন্দরভিত্তিক বৈধ বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে চোরাচালান জোরদার করেছে।

জানা গেছে, আরাকান আর্মি রাখাইন বা আরাকান রাজ্য দখলে নেওয়ার পর এখন তারা যুদ্ধ করছে কিয়াকফিউ বা কেপ্রু শহর-বন্দর ঘিরে। সিট্টুয়ে বা আকিয়াবসহ যেসব বন্দর থেকে সাগরপথে টেকনাফ বন্দরে বাণিজ্যের মালামাল আসে ওই সব নৌপথ দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। এ সুযোগে চাঁদা দাবি করে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করতে থাকে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে বাণিজ্যের জাহাজ আটকে শ্রমিকদের শারীরিক নির্যাতনসহ ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি করতে থাকে। এ কারণে বন্দরভিত্তিক ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এতে বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।

ব্যবসায়ী মো. নাছির বলেন, ‘আরাকান আর্মির কারণে গোটা সীমান্ত এলাকা আজ অস্থিতিশীল। নাফ নদে জেলেরা মাছ শিকার করতে পারে না। পাহাড়ি সীমান্তে স্থলমাইন বসিয়ে আমাদের বাঁশ-কাঠ শ্রমিকদের হত্যা করছে। চাঁদাবাজি এবং গুন্ডামির কারণে সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে বন্দর অচল হয়ে পড়েছে। এ সুযোগে মাদকের রমরমা কারবার ও অবৈধ চোরাচালান আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।’

বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্য সমিতির টেকনাফ উপজেলা শাখার সভাপতি মো. তৈয়ব বলেন, আরাকান আর্মির ভয়ে দীর্ঘদিন থেকে নাফ নদে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। এতে খেয়ে না-খেয়ে দিন পার করছেন নাফ নদ উপকূলের ক্ষুদ্র জেলেরা।

উখিয়া টেকনাফের দুই উপজেলার লক্ষাধিক পরিবারের জীবন-জীবিকা চলে নাফ নদে মাছ শিকার করে। কিন্তু আরাকান আর্মির দৌরাত্ম্যে দিশেহারা তারা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটছে তাদের দিন। অপহরণের ভয়ে সাগরে যেতে চান না অনেকে।

টেকনাফের শাহ্পরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, পশ্চিমপাড়া, সাবরাং মুন্ডার ডেইল, বাহারছড়া, টেকনাফ সদরের তুলাতুলি, লেঙ্গুর বিল ঘাট ও বাহার ছড়া ইউপির কয়েকটি ঘাটসহ টেকনাফ পৌর এলাকার খায়ুকখালী নৌঘাট ঘুরে দেখা যায়, আরাকান আর্মির ভয়ে সাগরে মাছ ধরতে না পাঠিয়ে ট্রলারগুলো অলস বসিয়ে রেখেছেন ট্রলার মালিকরা।

এদিকে প্রশাসনের দাবি, জেলেরা নাফ নদ ও সাগরের জলসীমানা অতিক্রম করাও আরাকান আর্মি কর্তৃক জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়ার একটি কারণ।

এ বিষয়ে শাহপরীর দ্বীপ ছোট নৌকাঘাটের সভাপতি আব্দুল গফুর বলেন, ‘সাগরে মাছ শিকারে গেলেই জেলেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। তাদের ভয়ে জেলেরা সাগরে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। তাদের দমন করতে না পারলে জেলেরা মাছ ধরা বন্ধ রেখে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হবেন। বিজিবি ও কোস্ট গার্ডকে আমরা এসব বিষয় অবগত করেছি কিন্তু টেকসই কোনো সমাধান পাচ্ছি না।’

গফুর আরও জানান, দীর্ঘ ৯ মাস ধরে আরাকান আর্মির আনাগোনা রয়েছে সাগরে ও নাফ নদে। কোস্ট গার্ড ও বিজিবি টহল থাকলেও তাদের নেই সাগরে চলাচল উপযোগী দ্রুতগামী নৌযানসহ প্রয়োজনীয় জনবল। আরাকান আর্মির কব্জায় থাকা জেলে পরিবারের মধ্যে চলছে কান্নার আহাজারি।

টেকনাফের কর্মরত সংবাদকর্মী শহিদুল্লাহ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে টেকনাফে। আরাকান আর্মির ভয়ে জেলেরা মাছ শিকারে ভয় পাচ্ছে, বন্দরের ব্যবসা বন্ধে নীরব এক দুর্ভিক্ষ  গ্রাস করেছে।
আমদানিকারক এক্সপ্রেস এজেন্সির প্রতিনিধি মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, আরাকান আর্মি কর্তৃক অনুমোদন না পাওয়ায় পণ্য রপ্তানি করা যাচ্ছে না। মিয়ানমার থেকেও টেকনাফ স্থলবন্দরে কোনো পণ্য প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। বন্দরের গুদামগুলোয় সিমেন্ট, আলু এবং অন্যান্য কিছু খাদ্যপণ্য রয়েছে। এগুলো প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। ফলে প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এর কারণে শত শত বন্দর ব্যবসায়ী সমস্যায় পড়ছেন। এখন দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য পুনরায় চালু করতে তারা সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করেন।

টেকনাফ স্থলবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তা মো. সোহেল উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি, তারও বন্দরটি চালু করার চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে জেলার সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যেই রপ্তানির জন্য আনা আলু, সিমেন্টও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

টেকনাফ স্থলবন্দরের ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, গত তিন মাস বন্দরে কোনো মালামাল আসেনি। মিয়ানমারে রপ্তানির জন্য বন্দরে মজুত থাকা ২২ হাজার ৮৫০ ব্যাগ সিমেন্ট, ২ হাজার ৭০০ ব্যাগ আলু, ১ হাজার ৯০ ব্যাগ কোমল পানীয়সহ বিভিন্ন পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জানতে চাইলে টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে এরই মধ্যে অনেক সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। বিজিবির প্রচেষ্টায় গত ডিসেম্বর থেকে কয়েক দফায় মিয়ানমার থেকে ১৮৯ জন জেলেকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। প্রথমবারের মতো ২৭টি নৌযান ফেরত এনে মালিকদের হস্তান্তর করা হয়।

এ প্রসঙ্গে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, বন্দরে ব্যবসা বন্ধ থাকার বিষয়টি সঠিক। তবে এ বাণিজ্য চালুর ক্ষেত্রে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষসহ আরও কিছু পক্ষের সঙ্গে আলোচনা প্রয়োজন আছে।

তিনি আরও বলেন, বন্দরের সভাপতি হলেও যোগ দেওয়ার পর থেকে বন্দর নিয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এ ছাড়া সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াতে বিধিনিষেধ সম্পর্কে তিনি বলেন, সেটি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় তিনি এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে পারছেন না। তবে সেন্টমার্টিনের অধিবাসীদের যাতে সমস্যা না হয়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

টেকনাফ বন্দর ব্যবসায়ী সমিতির (সিএন্ডএফ) সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর জানান, আরাকান আর্মির বিচরণ রোধে দুই দেশের সংশ্লিষ্টদের আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা খুবই জরুরি। না হলে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!