বাংলাদেশের রন্ধন সংস্কৃতিতে ডালের উপস্থিতি অনিবার্য। প্রতিদিনের খাবারে ভাতের সঙ্গে এক প্লেট মসুর ডাল যেন আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। কিন্তু শুধু রন্ধনে নয়, কৃষকের দৃষ্টিতেও এটি একটি লাভজনক, কম পরিচর্যায় চাষযোগ্য এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল। একই সঙ্গে শুষ্ক ও অনুর্বর জমিতেও এই ফসল ফলানো সম্ভব হওয়ায় দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তাই রবি মৌসুমের আগেই শিখে রাখুন মসুর ডাল চাষ। বাংলাদেশ কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যানুসারে মসুর ডাল চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানাচ্ছেন আরফান হোসাইন রাফি
উপযুক্ত মাটি ও আবহাওয়া : মসুর চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী জমি হলো সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি। জলাবদ্ধতা সহ্য না করায় জমিতে পানি জমে থাকলে তা দ্রুত বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সাধারণত রবি মৌসুমে কম বৃষ্টিপাত, হালকা শীত এবং পরিমিত রোদ মসুর গাছের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। যদি রবি মৌসুমকে টার্গেট করে চাষাবাদের পরিকল্পনা থাকে তবে এখনই বীজতলার কাজ শুরু করতে হবে।
উন্নত জাতের পরিচিতি : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঅজঈ) কর্তৃক উদ্ভাবিত বিভিন্ন উচ্চফলনশীল মসুর জাত বর্তমানে দেশের কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। যার মধ্যে-
বারি মসুর-১ : এটি মধ্যম আকৃতির গাছ। পাতা গাঢ় সবুজ, ফুল সাদা। রান্নার সময় কম (১০-১২ মিনিট)।
বীজ তুলনামূলক বড় (১৫-১৬ গ্রাম/হাজার বীজ)। আমিষ ২৬-২৮%। ফলন ১.৭-১.৮ টন/হেক্টর। জীবনকাল ১০৫-১১০ দিন।
বারি মসুর-২ : এটি সামান্য লতানো প্রকৃতির গাছ। রান্না করতে কিছুটা সময় বেশি লাগে (১৪-১৬ মিনিট)। হাজার বীজ ওজন ১২-১৩ গ্রাম।
ফলন ১.৫-১.৭ টন/হেক্টর। আমিষ ২৭-২৯%।
বারি মসুর-৩ : এটি সংকর জাত। বীজের রং ধূসর, তাতে ছোট কালচে দাগ থাকে। রান্না সহজ (১০-১২ মিনিট)। হাজার বীজ ওজন ২২-২৫ গ্রাম। ফলন ১.৫-১.৭ টন/হেক্টর। জীবনকাল ১০০-১০৫ দিন।
বারি মসুর-৪ : বারি মসুর-৪ পাতার শীর্ষে আকর্ষি, ফুল বেগুনি। বীজ চেপ্টা, লালচে বাদামি রঙের। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি (মরিচা ও স্টেমফাইলিয়াম ব্লাইট)। রান্না হয় ১১-১৩ মিনিটে। ফলন ১.৬-১.৭ টন/হেক্টর।
বীজ বপন ও জমি প্রস্তুতি
বপনের সময় : সাধারণত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ (কার্তিকের দ্বিতীয়-তৃতীয় সপ্তাহ) মসুর বীজ বপনের জন্য উপযুক্ত সময়। তবে আগস্ট থেকেই এর বীজতলার কাজ শুরু করলে ফলন ভালো হয়।
বপন পদ্ধতি : মসুর ডাল সারি করে বা ছিটিয়ে বপন করা যায়। সারি পদ্ধতিতে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সেমি রাখা ভালো। বপনের পর একবার হাল দিয়ে চাষ করে আড়াআড়ি দুইবার মই দিতে হবে।
বীজের পরিমাণ : মসুর ডালের বীজের পরিমাণ সাধারণভাবে ৩০-৩৫ কেজি/হেক্টর বীজ যথেষ্ট। তবে বারি মসুর-৩ এর জন্য ৩৫-৪০ কেজি প্রযোজ্য।
প্রাইম পদ্ধতিতে মসুর চাষ : মসুর ডালের প্রাইম পদ্ধতি সাধারণত শুষ্ক জমির জন্য। রোপা আমন কাটার পর অনেক সময় জমিতে রস থাকে না। এক্ষেত্রে বীজ প্রাইমিং অত্যন্ত কার্যকর।
পদ্ধতি : মসুর ডালের বীজ ৮-১০ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছায়ায় শুকিয়ে ওই দিনই জমিতে বপন করতে হবে। এতে দ্রুত চারা গজায় এবং গাছের বৃদ্ধিও ভালো হয়।
সার ব্যবস্থাপনা : মসুর ডালের সার ব্যবস্থাপনায় জমি তৈরির শেষ চাষের সময় সার প্রয়োগ করতে হয়। যেখানে প্রতি হেক্টরে প্রয়োজনীয় সার ইউরিয়া ৪০-৫০ কেজি, টিএসপি ৮০-৯০ কেজি, এমওপি ৩০-৪০ কেজি, অণুজীব সার প্রতি কেজি বীজে ৯০ গ্রাম (যদি আগে মসুর চাষ না হয়)। এ ছাড়া যদি ইনোকুলাম ব্যবহার করা হয়, তাহলে ইউরিয়া প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। জীবাণু সারের সঙ্গে ভাতের মাড় বা চিটাগুড় মিশিয়ে বপন করলে আরও ভালো ফলন পাওয়া যায়।
সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ : চারা গজানোর ২৫-৩০ দিনের মধ্যে একবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। যদি জমিতে রসের অভাব হয়, তবে হালকা সেচ দিতে হবে এবং পরে জমি আলগা করে দিতে হবে। সব সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন জমিতে জলাবদ্ধতা না হয়।
বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি : বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে (আর্দ্রতা ১০% এর নিচে) রাখতে হবে। এরপর টিনের ড্রাম, পলিথিন মোড়ানো চটের বস্তা বা আলকাতরায় প্রলেপ দেওয়া মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহ ও লাভবান হওয়ার সুযোগ : মধ্য-ফাল্গুন থেকে মধ্য-চৈত্র (মার্চ মাস) মসুর ফসল সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। সময়মতো ফসল কেটে শুকিয়ে মাড়াই করতে হবে। বাজারে মসুর ডালের চাহিদা সারা বছরই থাকে। তাই রবি মৌসুমে সঠিক জাত নির্বাচন, প্রাইম পদ্ধতি প্রয়োগ এবং রোগবালাই দমন করে যে কেউ কম খরচে অধিক লাভের পথে এগিয়ে যেতে পারেন।