আমদানি করা চীনা পণ্যের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল বাংলাদেশের অর্থনীতি। গত অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে ১ হাজার ৬৬৪ কোটি ডলার, যা মোট আমদানি ব্যয়ের ২৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪১ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য, যা মোট রপ্তানির কেবল ১ শতাংশ।
বড় অঙ্কের এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশের পাশেও দাঁড়িয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ চীন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় দেশটি। ২০২২ সালে এসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যকে দেওয়া হয় এই সুবিধা।
পরের বছর যুক্ত হয় আরও ৩৮৩টি পণ্য। ২০২৩-এর আগস্টে নতুন করে ১ শতাংশ; আর গত ডিসেম্বর থেকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শতভাগ পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় চীনা সরকার। এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার এবারের চীন সফরে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাস্তবায়নে দর কষাকষির তাগিদ দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ চায়না চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা বলেন, পণ্য চীনের বাজারে প্রবেশ করানোর জন্য আরও সচেষ্ট হতে হবে। পাশাপাশি দেশে বাড়াতে হবে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ। এতে কমবে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ। প্রধান উপদেষ্টার এবারের চীন সফরে এই বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশে শীর্ষ বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে কখনো দ্বিতীয়, আবার কখনো তৃতীয় অবস্থানে থাকে চীন। ২০২১-২২ অর্থবছরের পর বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। তাই দেশটিতে রপ্তানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রেড বাস্কেটটি আরও বৈচিত্র্যময় করতে হবে। এদিকে বেশি নজর দিতে হবে। পাশাপাশি বাড়াতে হবে দেশের উৎপাদনক্ষমতা, যাতে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও ভালো করতে হবে। বিশেষ করে দেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হলে সেই বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করে রপ্তানি পণ্য চীনের বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে। চীন আমদানি করে এমন পণ্যের উৎপাদনে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর ওপরও জোর দেন এই অর্থনীতিবিদ।
এদিকে আজ বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস চীনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন বলে জানা গেছে। তিনি দক্ষিণ চীনের হাইনান প্রদেশে অনুষ্ঠিতব্য বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেবেন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
সূত্র জানায়, সফরের মূল লক্ষ্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করা। বৈঠকে ইউনূস চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করবেন, যার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় একটি চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ-চীন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা শুরু করা।
এছাড়া, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে চীনা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং আসিয়ানে (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট) বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়েও আলোচনা হতে পারে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, ২৮ মার্চ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ সময় দুই দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন আশা প্রকাশ করেছেন যে ইউনূসের সফর অত্যন্ত সফল হবে এবং বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৩৮ মিলিয়ন ডলারের অনুদানের একটি অংশ দিয়ে বাংলাদেশে ৫০০ থেকে ১,০০০ শয্যার একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। হাসপাতালটি এমনভাবে গড়ে তোলা হবে, যাতে বিদেশে চিকিৎসার জন্য রোগীদের যাওয়া কমে আসে এবং দেশেই উন্নত চিকিৎসার সুযোগ নিশ্চিত হয়। হাসপাতালের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঢাকার উত্তরা ও মিরপুর এবং চট্টগ্রামের একটি এলাকা প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে আসিয়ান ও আরসিইপি বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির জন্য চীনের সহযোগিতা চাওয়া হতে পারে। পাশাপাশি, বেইজিং বাংলাদেশ-চীন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দিতে পারে। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার শেষ চীন সফরের সময় এফটিএ আলোচনা শুরুর বিষয়ে চুক্তি হলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনার সফরের সময় চীনের কাছে ১২টি প্রকল্পে অর্থায়নের প্রস্তাব করা হলেও তখন অগ্রগতি হয়নি। এবার সেই প্রকল্পগুলোর কয়েকটি আলোচনায় আসতে পারে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ চুক্তি হয়নি। চলতি অর্থবছরেও চীনের সঙ্গে নতুন কোনো ঋণচুক্তির সম্ভাবনা নেই। সর্বশেষ ঋণচুক্তি ২০২৩ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেটি ছিল রাজশাহী ওয়াসার সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্পের জন্য ২৭৬.২৫ মিলিয়ন ডলারের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার সফরের সময় চীনের সঙ্গে নতুন প্রকল্পের ঋণ চুক্তি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এর মধ্যে চারটি জাহাজ কেনার জন্য ২৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি এবং মোংলা বন্দরের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের জন্য ৩৫৩.৫২ মিলিয়ন ডলারের ঋণ আলোচনায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
 

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন