ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

আল্লাহ যে জাতিকে ভূমিকম্প দিয়ে ধ্বংস করেছিলেন

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২৫, ০৪:৫১ পিএম
সমকামিতার মতো জঘন্য অপকর্ম তারা প্রকাশ্যে করে আনন্দ লাভ করত। তাই আল্লাহ তাদের ভয়ংকর ভূমিকম্পে ধ্বংস করেছেন। ছবি- সংগৃহীত

দুনিয়ার সর্বত্র আজ প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন নিত্যসঙ্গী। কখনো ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, আবার কখনো বিধ্বংসী ভূমিকম্প—এসবের মধ্য দিয়ে মানুষ স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় তার প্রকৃত অবস্থান ও সীমাবদ্ধতা। ইসলামের দৃষ্টিতে, এসব ঘটনা কখনো মুমিনদের জন্য পরীক্ষা, আবার কখনো অসৎ ও গোনাহে নিমজ্জিত মানুষের জন্য সতর্কবার্তা।

আল্লাহ কুরআনে বলেন, তিনি ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও জীবনহানির পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাঁর বান্দাদের পরখ করবেন। আর যারা ধৈর্য ধরে বলেন—‘আমরা আল্লাহরই জন্য, এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাব’—তাঁরাই সুসংবাদপ্রাপ্ত। (সুরা বাকারা : ১৫৫–১৫৬)

ইতিহাসের পাতায় বহু জাতি আছে, যারা বারবার সতর্কবার্তা পেয়েও নিজেদের অপকর্ম থেকে ফিরেনি। ফলে এসেছে ভয়ংকর শাস্তি। সেইসব শাস্তির মধ্যে অন্যতম হলো হজরত লূত (আ.)-এর জাতির ধ্বংস, যা সংঘটিত হয়েছিল এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প ও আকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত পাথরের মাধ্যমে।

সমৃদ্ধি পেয়েও নৈতিক অবক্ষয়ে ডুবে যাওয়া জাতি

আল্লাহ তাআলা লূত (আ.)-এর জাতিকে দান করেছিলেন উর্বর জমি, প্রচুর সম্পদ এবং স্বচ্ছল জীবন। প্রাচুর্যের মাধুর্যে তারা এতটাই আত্মতুষ্ট হয়ে ওঠে যে আল্লাহর বিধান ভুলে গিয়ে সীমালঙ্ঘনকে জীবনের নিয়ম বানিয়ে ফেলে।

এই জাতি প্রথমবারের মতো পৃথিবীতে সমকামিতা প্রচলন করে—এক অশ্লীল কাজ যেটা তাদের আগে কোনো জাতি কখনো করেনি। তাই কুরআনে আল্লাহ বলেন—‘তোমরা এমন অশ্লীলতা করছ যা তোমাদের পূর্বে কেউ করেনি। তোমরা মেয়েদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে যাচ—তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী জাতি।’ (সুরা আ’রাফ : ৮০–৮১)

লূত (আ.) তাঁদের বহুবার সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই পাপাচার আল্লাহর কঠিন শাস্তি ডেকে আনবে। কিন্তু জাতি তাঁকে উপহাস করত, তাঁর কথা উপেক্ষা করত, বরং অনেক সময় কষ্ট দিত। এমনকি তাঁর স্ত্রীও পাপীদের পক্ষ নিত।

ফেরেশতাদের আগমন: পাপীদের শেষ সতর্কতা

একদিন তিন ফেরেশতা—জিব্রাইল (আ.), ইস্রাফিল (আ.) এবং মিকাইল (আ.)—সুদর্শন যুবকের রূপে লূত (আ.)-এর এলাকায় আসেন। লূত (আ.) অনুভব করেছিলেন তাঁর জাতির পাপাচারী পুরুষরা অতিথিদের দিকে ঝুঁকে পড়বে, তাই তিনি গোপনে তাঁদের আশ্রয় দেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী খবরটি ফাঁস করে দেয়। পাপী সম্প্রদায় অশ্লীল উদ্দেশ্যে লূত (আ.)-এর ঘর ঘিরে ফেলে।

তখন ফেরেশতারা নিজেদের পরিচয় দেন এবং লূত (আ.)-কে আশ্বস্ত করে বলেন—‘হে লূত! আমরা তোমার পালনকর্তার প্রেরিত ফেরেশতা। এরা তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি রাতের কিছু অংশ বাকি থাকতে তোমার পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। কেউ পিছনে তাকাবে না। তোমার স্ত্রীও পাপীদের সাথে শাস্তির আওতাভুক্ত হবে।’ (সূরা হুদ : ১১)

এরপর জিব্রাইল (আ.) এক আঘাতে পুরো দলের লোকদের চোখ অন্ধ করে দেন। তারা আতঙ্কে ছুটোছুটি করতে থাকে, আর লূত (আ.) পরিবার নিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন।

ভোরের অন্ধকারে নেমে এলো শাস্তির ঝড়

লূত (আ.) তাঁর পরিবারকে নিয়ে যখন নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছালেন, তখনই শুরু হলো অবাধ্য জাতির ওপর আল্লাহর ঘোষিত পরিণতি। গভীর ভোরের অন্ধকারে প্রথমে প্রবল এক ভূমিকম্প সমগ্র জনপদকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। চারদিক কেঁপে ওঠে, ঘরবাড়ি ভেঙে যেতে থাকে।

এরপর জিব্রাইল (আ.) তাঁর ডানার শক্তি দিয়ে পুরো নগরীটিকে ভিত্তিসহ আকাশে তুলে নেন। এত উঁচুতে উঠানো হয় যে প্রথম আসমানের ফেরেশতারাও নিচের জনপদের পশুপাখির ডাক শুনতে পান। তারপর আচমকা সেই নগরীটিকে উল্টো করে ফেলে দেওয়া হয় ভূমির ওপর, যেন পৃথিবী নিজেই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছে।

কিন্তু এখানেই শাস্তির শেষ হয়নি। নগরী পতনের পরই আকাশ থেকে নেমে আসে পাথরের বৃষ্টি—যে পাথরগুলোতে প্রতিটি পাপীর নাম লেখা ছিল। যারা শহরের বাইরে ছিল, তারাও এই শাস্তি থেকে রেহাই পায়নি; পাথর তাদেরও খুঁজে নেয়।

সবশেষে সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকায় প্রবাহিত করা হয় দূষিত, অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি, যার ফলে পুরো অঞ্চলটি হয়ে ওঠে নিঃজীব ও অনুর্বর—যেন চিরদিনের জন্য অভিশপ্ত এক ভূমি।

আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘আমি জনপদটিকে উল্টে দিয়েছি এবং তাদের ওপর স্তরে স্তরে পাথর বর্ষণ করেছি।’ (সূরা হুদ : ৮২)

ধ্বংসের স্মৃতি: আজকের ডেড সি বা মৃত সাগর

হজরত লূত (আ.)-এর জাতির সেই ভয়াবহ ধ্বংসভূমি আজ পরিচিত বাহরে মাইয়েত, বাহরে লুত বা ডেড সি নামে। বর্তমানে এটি ফিলিস্তিন ও জর্দানের মাঝামাঝি বিশাল এলাকায় বিস্তৃত। পৃথিবীর অন্যতম সবচেয়ে নিচু স্থানে অবস্থিত এই সাগরে রয়েছে এক অস্বাভাবিক প্রকৃতি—পানিতে আছে প্রচুর লবণ ও খনিজ, যা স্বাভাবিক পানির তুলনায় বহু গুণ বেশি ঘন।

এই অতিরিক্ত ঘনত্বের কারণে এখানে কোনো মাছ, ব্যাঙ বা জলজ প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। পানি এত ভারী যে মানুষ সহজেই এর ওপর ভাসতে পারে। চারপাশে নেই কোনো প্রাণের চিহ্ন—শুধু নিস্তব্ধতা, নীরবতা আর লবণস্তূপে ঢাকা নির্জন তীর। যেন পুরো অঞ্চল বলছে, এখানে একসময়ে নেমে এসেছিল ইতিহাসের ভয়ংকরতম শাস্তি।

এই কারণেই একে ‘মৃত সাগর’ বলা হয়। বহু গবেষক মনে করেন, এই এলাকার অস্বাভাবিক ভূস্তর, অতিলবণাক্ত পানি এবং চিরপ্রাণহীন প্রকৃতি—সবই সেই ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞের চিরস্থায়ী স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।