মার্চের মতো ভোক্তা পর্যায়ে এলপি গ্যাসের (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) দাম চলতি এপ্রিল মাসেও বাড়ছে না বা কমছে না। চলতি মাসের জন্য ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম এক হাজার ৪৫০ টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
গত মাসে ভোক্তা পর্যায়ে যার দাম ছিল এক হাজার ৪৫০ টাকা। কিন্তু বাজারের কোথাও এই দামে মিলছে না কোনো সিলিন্ডার। ভোক্তাদের জিম্মি করে ইচ্ছামতো দাম আদায় করছেন ব্যবসায়ীরা।
এর কারণ হিসেবে ভোক্তারা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সিদ্ধান্তে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে আবাসিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ। ফলে বাধ্য হয়ে ভোক্তাদের ঝুঁঁকতে হয়েছে এলপিজির দিকে।
আর এর ফলে গুটিকয়েক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নিয়মিত দাম নির্ধারণ করে দিলেও তার তোয়াক্কা না করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে দিনের পর দিন তারা চালাচ্ছেন দৌরাত্ম্য।
গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলন করে বিইআরসি নতুন দামের এ ঘোষণা দেয়। এ সময় চলতি মাসের জন্য অটোগ্যাসের দামও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
৬৬ টাকা ৪৩ পয়সা থেকে ২ পয়সা কমিয়ে অটোগ্যাসের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয় ৬৬ টাকা ৪১ পয়সা।
সরেজমিনে বাজার পরিস্থিতি
রবিবার বিইআরসির সংবাদ সম্মেলনের পর রাজধানীর শান্তিনগর, মৌচাক, মগবাজার, হাতিরপুল, গ্রীন রোডসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে কোথাও ১৬শ টাকার নিচে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার পাওয়া যায়নি। 
সরকারের পক্ষ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকা দাম নির্ধারণ করা হলেও কেন ১৬শ টাকা দাম চাওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে রাজধানীর মগবাজারের গাবতলা এলাকার নুরুল এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা বলেন, ‘আপনেরে কেডা কইছে দাম ১৪শ টাকা।
গত বছরের আগস্ট মাস থেইক্কাই আমরা ১৬শ টাকা করে বেচতাছি। নিলে নেন নাইলে যান।’ প্রায় একই রকমভাবে তাচ্ছিল্যের সুরে মগবাজার রেলগেট এলাকার আহমেদ এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা শিপন মিয়া বলেন, ‘সরকার কত টাকা নির্ধারণ কইরা দিছে আমরা জানি না।
মালিক আমাগো কইছে ১৬শ টাকার কম এক টাকাও রাখা যাইব না। আপনের দাম আপনে নিজের কাছে রাখেন।’
হাতিরপুল, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি এলাকায় এ চিত্র আরও ভয়াবহ। এসব এলাকায় খুচরা বিক্রেতারা সিলিন্ডারপ্রতি ৩শ থেকে ৪শ টাকা পর্যন্তও বেশি দাম আদায় করছেন।
ধানমণ্ডি-৭ এলাকার বাসিন্দা শাহনাজ বেগম ১২ কেজির এক সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে এসেছেন তানিয়া এন্টারপ্রাইজে।
খবরে দেখেছেন, বিইআরসি থেকে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪৫০ টাকা। সেই মোতাবেক টাকা নিয়ে কিনতে এলেও বিক্রেতা কোনোভাবেই ১৬শ টাকার নিচে সিলিন্ডার দেবে না।
অসহায় হয়ে বাড়তি টাকা আনার জন্য বাড়ির দিকে রওনা দিলে কথা হয় প্রতিবেদকের সঙ্গে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এমন দাম নির্ধারণের কী প্রয়োজন বলেন। যা বিক্রেতারা মানবেই না।
শুধু শুধু সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। আমরা তো সব ধরনের পণ্যে বাড়তি দাম দিয়ে অভ্যস্ত হয়েই গের্ছি। এমন নাটকের আর কী দরকার।
বাড়তি এ দাম দিয়ে সিলিন্ডার কিনতে নারাজ বেসরকারি কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানও। মগবাজার চেয়ারম্যান গলির এই বাসিন্দা বলেন, সরকার থেকে যদি দাম নির্ধারণ করে দেওয়াই হয়, তাহলে তদারকি কেন করা হয় না? ডিমের দাম বাড়লে না হয় সবজি খেয়ে থাকা যায়।
কিন্তু গ্যাসের তো বিকল্প নেই। বাড়তি দামেও কিনতেই হবে। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে- শুধু দাম নির্ধারণ করে দিয়েই বসে না থেকে বাজার তদারকি করা হোক। না হলে আমাদের ভোগান্তি কোনোভাবেই কমবে না।
গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে বন্ধ আবাসিক সংযোগ! জানা যায়, গ্যাস সংকটের কথা উল্লেখ করে ২০০৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়।
পরে ২০১৩ সালের শেষের দিকে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ চালু করা হলেও ২০১৪ সালের পর জ্বালানি বিভাগ গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে আবাসিকের নতুন আবেদন নিতে নিষেধ করে।
এরপর ২০১৯ সালে লিখিতভাবে আবাসিক সংযোগ স্থগিত রাখার আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু খোদ জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী চাইলেও তার খুব কাছের কিছু ব্যবসায়ীর চাপে বার বার আবাসিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের পুনঃসংযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে বাধ্য হয় জ্বালানি বিভাগ।
বর্তমানে সারা দেশে বেক্সিমকোর পাশাপাশি বসুন্ধরা, ওমেরা, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (ফ্রেশ), এস আলম গ্রুপ, জেএমআই গ্রুপ, সিটি গ্রুপের মতো শিল্প জায়ান্টসহ প্রায় ৩০টি অপারেটর এলপিজি ব্যবসা করছে।
এর বাইরেও ফ্রান্সের টোটালগ্যাজ, ডাচ পেট্রোম্যাক্স এবং হংকংয়ের কাই হেং লং গ্লে¬াবাল এনার্জির মতো বিদেশি অপারেটরগুলোও বাজারে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। ফলে গত এক দশকে দেশের এলপিজি বাজার উল্লেখযোগ্য হারে বড় হয়েছে।
বাজার অপারেটররা জানান, ২০১৩ সালে এলপিজির চাহিদা ছিল ৮০ হাজার টন। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ এই চাহিদা ১৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ এক দশকের মধ্যে এলপিজির চাহিদা বেড়েছে ১৫ গুণ। আর এটারই সুবিধা নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, ওমেরা অন্যতম।
২০২১ সালের ১২ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত এলপিজির দর ছিল কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীন। বিইআরসি কর্তৃক দর ঘোষণার সময় বলা হয় আমদানিনির্ভর এই জ্বালানি সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে ভিত্তিমূল্য ধরা হবে।
এর পর থেকে প্রতি মাসেই এলপিজির দর ঘোষণা করে আসছে বিইআরসি। তবে বিইআরসির ঘোষিত দরে বাজারে পাওয়া নিয়ে অভিযোগ রয়েছে ভোক্তাদের।
তাদের অভিযোগ হচ্ছে, বাজারে নির্ধারিত মূল্যে পাওয়া যায় না এলপিজি সিলিন্ডার। বিক্রেতারা ইচ্ছামতো দর আদায় করেন। কর্মক্ষেত্রেই শাস্তির আওতায় আনার খবর আসছে।
বাড়তি দাম আদায় যেন নিয়মে দাঁড়িয়েছে: একেকটা সিলিন্ডারে ৩শ থেকে ৫শ টাকা বাড়তি আদায় করা যেন এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর জন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং খুচরা বিক্রেতারা দায়ী করছেন একে অপরকে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের এক জরিপে বলা হয়, এক সিলিন্ডার এলপি গ্যাস কিনতেই ভোক্তাদের মাসে অন্তত ২১৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে।
সমন্বিতভাবে এই অর্থ লোপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছে উৎপাদনকারী মিল, ডিলার, এমনকি খুচরা বিক্রেতারা। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের।
এমন পরিস্থিতিতে বিব্রত খোদ বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, আমরা দর ঘোষণা করে দিই। আমদানিকারকদের সঙ্গে বসেই দর চূড়ান্ত করি। ব্যবসায়ীরা অবশ্যই নতুন দাম মেনে চলবেন।
এ ক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিশেষ করে খুচরা বিক্রেতাদের যাতে করে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে বাজার তদারকি করা মুশকিল।
আমরা তো মাত্র কয়দিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। এ বিষয়ে আশা করি খুব দ্রুত কাজ শুরু করতে পারব। এ ক্ষেত্রে বাজার নজরদারির কোনো ব্যবস্থা করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলপিজির বাজার তো অনেক বড়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আবাসিকে পুনঃসংযোগের দাবি
তবে বিগত সরকার যে কারণেই হোক, প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ বন্ধ রাখলেও পরিবর্তিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে গ্যাসের পুনঃসংযোগ পাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অনেক সাধারণ গ্রাহক।
তারা বলছেন, মূলত গুটিকয়েক এলপিজি ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষায় বিগত সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এতে করে কার্যত আবাসিকে গ্যাসের সংযোগ বৈধ উপায়ে বন্ধ থাকলেও অধিকাংশ গ্রাহক অবৈধ উপায়ে সংযোগ নেয়।
এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি পুরোনো গ্রাহকেরই বেড়েছে বার্নারসংখ্যা। এতে করে বিতরণ কোম্পানিগুলোও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি তিতাস গ্যাস কার্যালয়ে সব শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতিতে সমন্বয় সভায় কর্মকর্তা বলেন, দিনের পর দিন আবাসিক খাতে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও অভিযান চালিয়ে সবাই প্রায় ক্লান্ত।
কারণ, আবাসিক খাতে অনেক বাড়িতে অবৈধ ব্যবহার হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তা চিহ্নিত করা তিতাসের জন্য কঠিন কাজ। তবে গ্রাহকরা অবৈধভাবে ব্যবহার করতে চান না। বৈধ সংযোগ বন্ধ থাকায় অবৈধ ব্যবহার বাড়ছে বলেও দাবি করেন তারা।
জানা যায়, মোট গ্যাসের ১২ শতাংশ ব্যবহার করা হয় আবাসিক খাতে। বাকিটা শিল্প ও অন্যান্য খাতে। অথচ প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে আবাসিক খাতে অবৈধ ব্যবহার বন্ধের অভিযানে।
অন্যদিকে শিল্পে হাজার হাজার অবৈধ সংযোগ থাকলেও সেদিকে নজর কম দেওয়া হচ্ছে।
যা বলছেন মাঠ কর্মকর্তারা
নতুন সংযোগের বিষয়ে মাঠ কর্মকর্তারা বলছেন, আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ বা বার্নার বর্ধিত করার অনুমোদন দিলে বিদ্যমান ব্যবহারের মধ্যেই শতকোটি টাকা রাজস্ব বাড়বে। 
নতুন গ্যাস বরাদ্দের দরকার হবে না। গ্রাহকরা কেবল কাগজ-কলমে বৈধতা পাবেন।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন