বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা ও নাপোলির জার্সিতে মোট ৮টি শিরোপা জয়, আর আর্জেন্টিনার হয়ে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ের নায়কত্ব- ফুটবলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা এই নাম ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। অধিকাংশ ফুটবল বিশেষজ্ঞের চোখে তিনি ব্রাজিলীয় কিংবদন্তি পেলের পাশাপাশি, অনেকে মনে করেন তার চেয়েও বেশি, ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার।
১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর বুয়েনস আইরেসে এক শ্রমজীবী পরিবারে জন্ম নেওয়া ম্যারাডোনার ফুটবল প্রতিভা মাত্র আট বছর বয়সে ধরা পড়ে। পাড়ার দল এস্ত্রেলা রোজার হয়েই শুরু হয় তার জাদুকরী পথচলা। কিন্তু কথায় আছে, নক্ষত্রকেও ঝড়ে যেতে হয়- ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। আজ, তার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে, আমরা রূপালী বাংলাদেশ তাকে স্মরণ করছি।
১৬ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের সঙ্গে প্রথম পেশাদার চুক্তিতে সই করেন তিনি। ১৯৮১ সালে বোকা জুনিয়র্সকে চ্যাম্পিয়ন করার পর ইউরোপের শক্তিশালী ক্লাব বার্সেলোনা তাকে দলে ভেড়ায়।
বার্সেলোনা থেকে নাপোলি
১৯৮২ থেকে ১৯৮৪- বার্সেলোনায় দুই মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৫৮ ম্যাচে ৩৮ গোল করেন ম্যারাডোনা। এই সময়ে জেতেন দুটি শিরোপা- কিংস কাপ ও স্প্যানিশ সুপার কাপ।
১৯৮৪ সালে তিনি পাড়ি জমান ইতালির নাপোলিতে। সেখানেই ফুটবল ইতিহাসে সৃষ্টি করেন এক অনন্য অধ্যায়। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৫৮ ম্যাচে ১১৫ গোল করার পাশাপাশি নাপোলিকে তিনি ইউরোপিয়ান পরাশক্তিদের সমকক্ষ পর্যায়ে উন্নীত করেন। নাপোলির জাদুঘরে তার হাত ধরেই যায় দুটি সিরি–আ শিরোপা, উয়েফা কাপ, ইতালিয়ান কাপ ও ইতালিয়ান সুপার কাপ।
পরবর্তীতে সেভিলা, নিউয়েল’স ওল্ড বয়েজ এবং বোকা জুনিয়র্সে খেলে ১৯৯৭ সালে শেষ হয় ম্যারাডোনার খেলোয়াড়ি জীবন।
১৯৮৬ বিশ্বকাপ
মেক্সিকো বিশ্বকাপ ১৯৮৬- যেখানে ফুটবল বিশ্বকে নতুনভাবে বিস্মিত করেন ম্যারাডোনা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে বিতর্কিত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের পাশাপাশি তিনি করেন ‘শতাব্দীর সেরা গোল’- ৬০ মিটার বল নিয়ে পাঁচজনকে কাটিয়ে অসাধারণ ফিনিশিং।
তার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। জাতীয় দলের হয়ে ৯১ ম্যাচে ৩৪ গোল- ছিল তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান।
কেলেঙ্কারি ও ঝড়ঝাপটা
মাঠের জাদুকর হলেও মাঠের বাইরে জীবন ছিল ঝড়বিক্ষুব্ধ। ১৯৯১ সালে ডোপিং পরীক্ষায় পজিটিভ হওয়ার পর ১৫ মাস নিষিদ্ধ হন তিনি। নিষিদ্ধ পদার্থ ব্যবহারের অভিযোগে ১৯৯৪ বিশ্বকাপ থেকেও বহিষ্কৃত হন।
একই সময়ে নাপোলিতে খেলার সময় গড়ে ওঠে তার কর–জটিলতা। ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে তার কর বকেয়া দাঁড়িয়েছিল ৩৭ মিলিয়ন ইউরোরও বেশি। ২০০৪ ও ২০০৭ সালে মাদকাসক্তিজনিত কারণে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
কোচিং ক্যারিয়ার
অসাধারণ ফুটবল ক্যারিয়ারের পর কোচিংয়ে সেই সাফল্যের ছিটেফোঁটাও দেখতে পাওয়া যায়নি। টেক্সটিল মান্দিউ, রেসিং ক্লাব পেরিয়ে ২০০৮ সালে আলফিও বাসিলের স্থলাভিষিক্ত হয়ে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের দায়িত্ব নেন তিনি।
কিন্তু ২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে ৪–০ গোলে পরাজয়ের পর তিনি বরখাস্ত হন। বাছাইপর্বে উরুগুয়ের বিপক্ষে জয়ের পর সাংবাদিকদের অপমানজনক মন্তব্য করায় ফিফা তাকে ২ মাস নিষিদ্ধ করে। এরপর আল–ওয়াসল, ফুজাইরাহ, ডোরাডোস দে সিনালোয়া এবং জিমনাসিয়া দে লা প্লাতায় কাটে তার পরবর্তী কোচিং–জীবন- কোনোটিতেই সাফল্যের ছাপ রাখতে পারেননি।
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়
ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর প্রথম বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনা ফিরে পায় ফুটবলের শীর্ষমুকুট। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে রোমাঞ্চকর ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে ৪–২ গোলে হারিয়ে ২০২২ সালে তৃতীয়বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় আলবিসেলেস্তেরা। স্বাভাবিক সময়ে ২–২ এবং অতিরিক্ত সময়ে ৩–৩ গোলের নাটকীয় লড়াই শেষে মেসিরা উঁচিয়ে ধরেন শিরোপা।

