ঢাকা মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৫

ফুটবল জাদুকর ম্যারাডোনার ৯ গল্প

স্পোর্টস রিপোর্টার
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৫, ০৪:১০ পিএম
ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ছবি- সংগৃহীত

ডিয়েগো ম্যারাডোনা- শব্দটি শুধুই নাম নয়, এটি এক অমর কাহিনী, এক জাদুকরী ছোঁয়া, যা ফুটবলকে নতুন অর্থ দিয়েছে। মাঠে তার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি ড্রিবল এবং প্রতিটি গোল কেবল খেলা নয়, বরং শিল্পের এক অনন্য প্রদর্শনী। ছোট বয়স থেকেই আর্জেন্টিনার গলিতে শুরু হওয়া তার যাত্রা, বিশ্বের বড় স্টেডিয়াম পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল- যেখানে তিনি কোটি দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন। কিন্তু ম্যারাডোনার জীবন ছিল কেবল খেলার সাফল্য নয়; এটি ছিল জাদু, প্রতিভা, উত্থান-পতন, মানবিক দুর্বলতা এবং নিজের চ্যালেঞ্জের সাথে লড়াই করার এক গল্প।

আজ জানাবো তার  শুরু হওয়া সেই কিংবদন্তি যাত্রা, যার প্রতিটি মুহূর্ত ফুটবল ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

চিরবিদায়: ২৫ নভেম্বর ২০২০

২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর ফুটবল বিশ্ব এক অভূতপূর্ব শূন্যতার মুখোমুখি হয়। ডিয়েগো ম্যারাডোনা ৬০ বছর বয়সে মারা যান। বুয়েনস আইরেসের বাড়িতে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যান তিনি। ময়নাতদন্তে দেখা যায়, তার ফুসফুসে পানি জমে (পালমোনারি এডিমা) এবং হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ বড়। মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের পরে পুনরুদ্ধারের সময় চিকিৎসার ত্রুটি তার অবস্থা আরও খারাপ করে। এমন একজন কিংবদন্তির মৃত্যু পুরো বিশ্বকে শোকাহত করে, যার খেলার জাদু এখন শুধুই স্মৃতিতে বেঁচে আছে।

বিশ্বব্যাপী শোক ও শ্রদ্ধা

ম্যারাডোনার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানোর সাথে সাথেই আর্জেন্টিনা সরকার জাতীয় শোক ঘোষণা করে। রোনালদিনহো, পেলেসহ অন্যান্য কিংবদন্তিরা তাকে শ্রদ্ধা জানায়। বিশ্ব মিডিয়ায় এই ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ম্যারাডোনা কেবল ফুটবল খেলেননি; তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটি সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক আইকন, যার প্রভাব প্রজন্মের পর প্রজন্মের ওপর পড়েছে।

১৯৮৬ বিশ্বকাপ

মেক্সিকো শহরে ২৯ জুন, ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনাকে পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে ৩-২ ব্যবধানে জয়ী করেন। কেবল গোল করা নয়, তিনি পুরো খেলাটির ভাগ্যই পরিবর্তন করেছিলেন। টুর্নামেন্টে তার দুটি গোল আজও ফুটবল ইতিহাসের অমর স্মৃতি। এগুলি কেবল প্রাত্যহিক খেলাধুলার নয়, বরং খেলায় কাঁচা প্রতিভার এবং জাদুর নিখুঁত মেলবন্ধনের প্রতীক।

‘ঈশ্বরের হাত’ এবং শতাব্দীর গোল

ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে ম্যারাডোনা বলটি ঘুষি দিয়ে গোল করেন, যা পরবর্তীতে ‘ঈশ্বরের হাত’ নামে পরিচিত হয়। চার মিনিটের মধ্যে তিনি পাঁচজন প্রতিপক্ষের মধ্য দিয়ে ড্রিবল করে গোল করেন। এই দুই মুহূর্ত ফুটবলে প্রতারণা এবং কবিতার এক অনন্য সংমিশ্রণকে প্রতিফলিত করে। এভাবেই তিনি খেলার জাদু এবং কৌশলিক বুদ্ধিমত্তার নিখুঁত উদাহরণ হয়ে ওঠেন।

ক্লাব ক্যারিয়ার: নাপোলির জাদু

নাপোলিতে, ম্যারাডোনা কেবল একজন খেলোয়াড় ছিলেন না; তিনি পুরো শহরকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। ১১৫টি গোলের মাধ্যমে তিনি সেরি ‘এ’-কে শীর্ষে নিয়ে আসেন এবং নাপোলিকে দুটি চ্যাম্পিয়নশিপ জেতান। তার জাদুকরী উপস্থিতি শহরের আবহ এবং ক্লাবের ইতিহাসকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দেয়। প্রতিটি খেলায় তিনি শুধু গোল করেননি, পুরো দলের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন।

সংখ্যা নয়, শিল্প

ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারটি ছিল ৪৪২টি ম্যাচে ২৫৬টি গোল। আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১টি ম্যাচে ৩৪টি গোল। বার্সেলোনা, বোকা জুনিয়ার্স, সেভিলা- প্রতিটি ক্লাবের জার্সিতে তিনি নিজস্ব গল্প তৈরি করেছিলেন। তবে পরিসংখ্যান যতই চিত্তাকর্ষক হোক, তার খেলার শৈল্পিকতা, সৃজনশীলতা এবং দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করার ক্ষমতা সংখ্যা দিয়ে কখনো পরিমাপ করা যায় না।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ 

যদিও ম্যারাডোনা শীর্ষ পর্যায় অতিক্রম করেছেন, ১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর্জেন্টিনাকে নকআউট পর্বে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পুনরায় প্রমাণ করেছিলেন তার দক্ষতা। তবে একটি ব্যর্থ মাদক পরীক্ষা হঠাৎ করে তার টুর্নামেন্ট শেষ করে দেয়। খেলায় তার রঙ ঝলমল করলেও, তার প্রভাব কখনো ম্লান হয়নি।

কোকেন এবং ব্যক্তিগত লড়াই

ম্যারাডোনার কোকেনের সঙ্গে সম্পর্ক নাপোলিতে শুরু হয় এবং কয়েক দশক ধরে তার জীবনকে প্রভাবিত করে। হাসপাতাল, পুনর্বাসন কেন্দ্র, গ্রেপ্তার- সবই তার জীবনের অংশ ছিল। দীর্ঘদিনের কোকেন এবং অ্যালকোহল ব্যবহার, সাথে চিকিৎসার ত্রুটি, তার শরীরকে দুর্বল করে। তবুও, তিনি এই লড়াই প্রকাশ্যে চালিয়েছিলেন এবং তার মানবিক দিকটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন- একজন সেলিব্রিটি হিসেবে যা খুব কম মানুষই করতে পারে।

কোচিং এবং মুক্তির প্রচেষ্টা

ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনাকে কোচ হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ২০১০ বিশ্বকাপ ফাইনালে দলকে পৌঁছে দিয়েছেন। মেক্সিকো, দুবাই সহ বিভিন্ন দেশে তিনি কোচিং করেছেন। খেলাটি কখনো ছাড়েননি, কারণ ফুটবল তার জীবনের সংজ্ঞা এবং ধ্বংস—দুইই। তিনি সর্বদা প্রমাণ করেছেন যে, ফুটবল তার জীবনের সবকিছু, এবং তার জাদু শুধু মাঠেই সীমাবদ্ধ ছিল না।