দখলদার ‘ইসরায়েল’ অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় গণহত্যা করছে না বলে মনে করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। উলটো ফিলিস্তিনিরা (বিশেষ করে হামাস) যুদ্ধে লিপ্ত বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এমনকি গাজায় খাবারের ব্যবস্থা করতে ‘ইসরায়েল’-এর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রোববার (৩ আগস্ট) নিউ জার্সির গলফ রিসোর্টে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন ট্রাম্প।
তবে পরদিন মার্কিন কর্মকর্তারা জানালেন, অবিলম্বে গাজা যুদ্ধ বন্ধের জন্য ‘ইসরায়েল’-এর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ট্রাম্পের সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও শেট বেটের অবসরপ্রাপ্ত প্রায় ৬০০ কর্মকর্তা। এই তালিকায় রয়েছে মোসাদ ও শেন বেটের সাবেক প্রধানরাও। তাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, ‘হামাস এখন আর ইসরায়েলের জন্য কৌশলগত কোনো হুমকি নয়’। খবর বিবিসির।
চিঠিতে ‘ইসরায়েলি’ সাবেক কর্মকর্তারা লিখেন, ‘ইসরায়েলিদের বড় অংশের কাছে আপনার বিশ্বাসযোগ্যতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে—যুদ্ধ থামান, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনুন, মানুষের দুর্ভোগের অবসান ঘটান।’
হামাসের সঙ্গে পরোক্ষ যুদ্ধবিরতির আলোচনা স্থগিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে গাজায় নতুন সামরিক অভিযান শুরু করতে চান ‘ইসরায়েলি’ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই খবর প্রকাশের পরই সাবেক ‘ইসরায়েলি’ গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তারা যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি খোলা চিঠি পাঠালেন।
চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মোসাদের সাবেক প্রধান তামির পার্দো, শিন বেতের সাবেক প্রধান আমি আয়ালন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা।
আমি আয়ালন বলেন, ‘এই যুদ্ধ শুরুতে ছিল ন্যায্য এবং প্রতিরক্ষামূলক। কিন্তু যখন আমরা সামরিক লক্ষ্য অর্জন করেছি, তখন থেকে এ যুদ্ধ আর ন্যায্য থাকেনি।’
এই সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা ‘কমান্ডারস ফর ইসরায়েল’স সিকিউরিটি (সিআইএস)’ নামের একটি সংগঠনের সদস্য, যারা বহুবার সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে যে, জিম্মিদের মুক্তির বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে। তারা আরও লেখেন, ‘গাজা যুদ্ধ থামান! আপনি লেবাননে এটা করেছেন, এবার গাজাতেও করার সময় এসেছে।’
গাজায় ব্যাপক ধ্বংস এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ ‘ইসরায়েল’কে আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমশ একঘরে করে ফেলছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে জনমত ‘ইসরায়েল’-এর প্রতি নেতিবাচক হচ্ছে, যা পশ্চিমা নেতাদের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ইসরায়েলি’ প্রধানমন্ত্রীর ওপর আদৌ কোনো চাপ প্রয়োগ করবেন কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও তিনি ধারাবাহিকভাবে নেতানিয়াহুর পাশে থেকেছেন, তবে গত সপ্তাহে তিনি স্বীকার করেন, নেতানিয়াহু বলেছিলেন গাজায় ‘প্রকৃত দুর্ভিক্ষ’ চলছে, অথচ তখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ‘ইসরায়েল’-এ হামাসের হামলায় প্রায় এক হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ‘ইসরায়েল’ গাজায় ভয়াবহ সামরিক অভিযান শুরু করে।
হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ‘ইসরায়েল’-এর আরোপিত কঠোর অবরোধে গাজায় প্রবেশে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় অঞ্চলটি ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখে পড়েছে। মন্ত্রণালয় জানায়, যুদ্ধ শুরুর পর এখন পর্যন্ত অপুষ্টিতে ১৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ৯৩ জন শিশু।
জাতিসংঘ-সমর্থিত সংস্থাগুলো বলছে, গাজায় বর্তমানে দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
সম্প্রতি হামাস ও ইসলামিক জিহাদ দুটি ‘ইসরায়েলি’ জিম্মির ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে তাদের শারীরিক ও মানসিক দুর্দশা স্পষ্ট। এক ভিডিওতে দেখা যায়, বাদামি পোশাকে এক নারী চোখে পানি নিয়ে একটি ছেলের পাশে বসে আছেন, ছেলেটির মুখেও ক্লান্তি ও যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। এই ভিডিও বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং ‘ইসরায়েলি’ ও পশ্চিমা নেতারা তীব্র নিন্দা জানান।
ভিডিও প্রকাশের পর নেতানিয়াহু দুটি জিম্মি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন এবং জানান, জিম্মিদের মুক্ত করতে প্রচেষ্টা ‘নিরন্তর ও নিরলসভাবে’ চলবে। তবে এক ‘ইসরায়েলি’ কর্মকর্তা স্থানীয় গণমাধ্যমে বলেন, নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে হামাসকে সামরিকভাবে পরাজিত করেই জিম্মিদের মুক্ত করতে চান।
এই অবস্থায় গাজায় নতুন সামরিক অভিযান ‘ইসরায়েল’-এর পশ্চিমা মিত্রদের আরও ক্ষুব্ধ করতে পারে। ফিলিস্তিনিদের অনাহার ও মৃত্যু নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র হচ্ছে। জিম্মিদের পরিবারের প্রতি সংহতি জানিয়ে কাজ করা একটি প্রধান সংগঠন বলেছে, ‘নতুন সামরিক অভিযান ইসরায়েল ও জিম্মিদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নেতানিয়াহু সবার সর্বনাশ করছেন।’