জাতীয় সনদে থাকা সুপারিশগুলো পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে অঙ্গীকার নেওয়া হবে। জুলাই সনদের অংশবিশেষের খসড়া গতকাল সোমবার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে চার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পদ্ধতি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার আলোচনা থেকে কিছু সময়ের জন্য ওয়াকআউট করে বিএনপি।
গতকাল দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনার শুরুতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমদ বৈঠক থেকে বের হয়ে যান। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ২০তম দিনের শুরুতে আলোচনার জন্য নির্ধারিত ছিল, প্রস্তাবিত সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিরীক্ষক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান-সংক্রান্ত বিষয়। সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দীন আহমেদ জানান, তারা আলোচনায় অংশ নেবে না। পরে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে অঙ্গীকার শেষে জুলাই সনদের অংশবিশেষের খসড়া তুল ধরা হয়েছে।
খসড়ায় রয়েছে, জুলাই সনদের পটভূমি, সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন ও কার্যক্রম এবং জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যে হওয়া সংস্কার সুপারিশগুলো দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
খসড়াটি এসেছে মাসব্যাপী রাজনৈতিক সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে, যা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। গতকাল দুপুরের বিরতির পরে দলগুলোর কাছে এ খসড়া পাঠানো হয়। খসড়া সনদের বিষয়ে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা সনদের ভাষা পর্যালোচনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে খসড়া পাঠিয়েছি। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, তা চূড়ান্ত সংলাপ শেষে চূড়ান্ত সনদে সংযোজন করা হবে।’
এ সনদে একটি বাধ্যতামূলক রোডম্যাপ নির্ধারিত হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক জবাবদিহি পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ এবং দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃত্ববাদ ও পদ্ধতিগত দুর্নীতির কবলে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারের লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
এনডোর্সমেন্ট ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দেবে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণআন্দোলনে নিহত হাজারো নাগরিকের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাবে এবং এ সনদকে একটি সম্মিলিত নৈতিক দায় হিসেবে গ্রহণ করে তা পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে; দেশের সাংবিধানিক কাঠামো, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ এবং দুর্নীতি দমনব্যবস্থাকে আইনি ও নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্গঠন করবে; নির্বাচিত পরবর্তী জাতীয় সংসদের প্রথম দুই বছরের মধ্যে সনদে উল্লিখিত সব আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বাস্তবায়ন করবে এবং গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অখ-তা রক্ষার জন্য বাধ্যতামূলক আইনি গ্যারান্টি দেবে।
এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো সনদে বর্ণিত আইনি, ঐতিহাসিক ও সাংবিধানিক সুরক্ষাগুলোর সংরক্ষণ ও শ্রদ্ধা জানাবে; ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আলোকে একটি ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক পদক্ষেপ হিসেবে এ সনদকে স্বীকৃতি দেবে। ঘোষণার শেষাংশে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত শহিদদের স্মরণ করে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতীয় সনদের পটভূমিতে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এসেছে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়। ওই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল ন্যায়বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এতে হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং আরও অনেকে আহত হন। এ ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
এ প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেন এবং গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। ৩৫টির বেশি রাজনৈতিক দল ও জোট এ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় এবং ২০টি মূল বিষয়ে আলোচনা করার জন্য মোট ৪৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়: সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন।
এ কমিশনগুলো তাদের সুপারিশ গত ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সরকারের কাছে জমা দেয়। পরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেই সুপারিশগুলোকে একত্র করে দুটি ধাপে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্য তৈরির কাজ চালায়।
সনদের খসড়ায় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, ভবিষ্যৎ আইন প্রণয়ন ও ফলোআপ রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সনদে বলা হয়েছে, এ সংস্কারগুলোকে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই কার্যকর করতে হবে। জুলাই জাতীয় সনদের এ খসড়া নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা।
তার আগে গত রোববার পুলিশ বাহিনীর পেশাদারত্ব ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং পুলিশি সেবাকে জনবান্ধব করার লক্ষ্যে একটি ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছে। জানানো হয়েছে, জুলাই সনদের খসড়া প্রস্তুত করার কথাও। এ ছাড়া এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে।