জন্ম: ১৮ আগস্ট, ১৯৩৬।। মৃত্যু: ১৩ আগস্ট, ২০২৫
আগামী ১৮ আগস্ট বহুমাত্রিক লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকারের (৯০) জন্মদিন। কিন্তু জন্মদিনের মাত্র পাঁচ দিন আগেই চিরনিন্দ্রায় পাড়ি জমিয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এই চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক সমালোচক। তার মৃত্যুতে পরিবারসহ স্বজন-সুহৃদদের মধ্যে আহাজারি সৃষ্টি হয়েছে।
গতকাল বুধবার বেলা পৌনে ৩টায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অধ্যাপক যতীন সরকার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন তার একমাত্র মেয়ে সুদীপ্তা সরকার। ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসাবে কর্মরত সুদীপ্তা সরকার বলেন, ‘আগামী ১৮ আগস্ট ছিল বাবার ৯০তম জন্মদিন। কিন্তু জন্মদিনের মাত্র পাঁচ দিন আগেই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আপনারা তাকে প্রার্থনায় রাখবেন, আশীর্বাদ করবেন, এটাই আমাদের চাওয়া।
তিনি আরও বলেন, বাবা চলে গেছেন, এটা দেশ ও সাহিত্য অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি। তার পরও বাবা তার স্বাভাবিক জীবন কাটিয়ে চলে গেছেন। তিনি ঘটনাবহুল ও বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়েছেন। নব্বই বছরের জীবনে তার যাত্রা পরিপূর্ণ হয়েছে এই পৃথিবীতে। তার কর্মের মাধ্যমেই তিনি বেঁচে থাকবেন।’
অধ্যাপক যতীন সরকারের মৃত্যুর আগে কোনো শেষ ইচ্ছা ছিল না জানিয়ে সুদীপ্তা সরকার বলেন, ‘মারা যাওয়ার আগে বিশেষভাবে উনি ওনার কোনো শেষ ইচ্ছা আমাদের কাছে বলে যাননি। মূলত পরিবারকেন্দ্রিক ওনার কোনো ইচ্ছা ছিল না। উনি সব সময় দেশ নিয়ে ভাবতেন। দেশ এবং মানুষ নিয়েই ওনার চিন্তা ছিল। প্রাকৃতজনের মানুষ হিসেবেই তিনি নিজেকে ভাবতে এবং এটা নিয়েই তার ভাবনা আবর্তিত হতো। পরিবার বা আমরা তার ওই ভাবনায় স্থান পেতাম না। এ নিয়ে আমাদের কোনো আক্ষেপ বা অভিযোগ ছিল না। আপনারা তাকে প্রার্থনায় রাখবেন।’
বাবার মৃত্যুর ঘটনায় দেশবাসীর কাছে আশীর্বাদ চেয়ে একমাত্র ছেলে স্লোভাকিয়া-প্রবাসী সুমন সরকার বলেন, ‘আমার বাবার শূন্যতা বাংলাদেশ পূরণ করতে পারবে না। বাবা সারা জীবন দেশকে নিয়ে ভেবে গেছেন। তার মনন, চিন্তা এবং কর্ম এই দেশ ও গণমানুষকে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। সেখানে পরিবারের কোনো অগ্রধিকার ছিল না। বাবা ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃত বাঙালি এবং প্রাকৃতজনের মানুষ। সবাই বাবার জন্য প্রার্থনা করবেন, আশীর্বাদ করবেন। বাবাকে মনে রাখবেন।’
জীবনের দীর্ঘ সময় ঢাকার বইরে বসবাস করলেও যতীন সরকার তার কর্ম আর মননশীলতায় জাতীয় পর্যায়ের বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় শক্তশালী অবস্থান করে নিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত ও কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন। কয়েক মাস আগে বিভিন্ন কারণে তার শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়। সুস্থ হওয়ার পর নেত্রকোনার নিজ বাড়িতে বসবাস করছিলেন। গত জুনে শোবারঘরের বারান্দা থেকে পত্রিকা আনতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার ঘটনায় তার ডান ফিমার নেক ফ্যাকচার হয়। এরপর তাকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
গত ৮ আগস্ট তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মাইন উদ্দিন খান। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিডনি সমস্যা, নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। নিয়মিত ডায়ালাইসিস চলছিল। তার চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হয়েছে। কিন্তু টানা ছয় দিন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকার পর আজ (বুধবার) বিকাল পৌনে ৩টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী কানন সরকার এবং এক ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে ছুটে আসেন পরিবারের সদস্যরাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী। এ সময় তারা প্রিয় মানুষকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
অধ্যাপক যতীন সরকার ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনার কেন্দুয়ার চন্দপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক এই শিক্ষক দীর্ঘ সময় মননশীল সাহিত্যচর্চা, বাম রাজনীতি এবং প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি দুই মেয়াদে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
লেখক হিসেবে অধ্যাপক যতীন সরকার অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑ স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১০), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পদক (২০০৭), প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার (২০০৫) ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার এবং মনিরুদ্দীন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কার। ৪২ বছরের বেশি সময় শিক্ষকতা পেশায় কাজ করে ২০০২ সালে অবসর গ্রহণের পর তিনি স্ত্রী কানন সরকারকে নিয়ে নেত্রকোনায় ফিরে আসেন। তার প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’, ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’, ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন’ ইত্যাদি।
প্রবীণ এই শিক্ষাবিদের মৃত্যুতে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে নেত্রকোনা জেলা সিপিবির সভাপতি অ্যাডভোকেট এমদাদুল হক মিল্লাত বলেন, অধ্যাপক যতীন সরকারের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। বাংলা সাহিত্যে তিনি অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন প্রাবন্ধিককে হারিয়েছে, একজন দেশপ্রেমিক লড়াকু মানুষকে হারিয়েছে। এ ক্ষতি আমাদের জন্য সহজে পূরণ হওয়ার নয়। ময়মনসিংহ থেকে যতীন সরকারের মরদেহ প্রথমে সরাসরি তার বাসস্থান শহরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ‘বানপ্রস্থে’ নিয়ে যাওয়া হয়। এই বাড়িতেই তিনি আড়াই দশকের বেশি সময় বসবাস করেছেন। সেখানে পরিবার ও স্বজনদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রাত ৮টায় যতীন সরকারকে নিয়ে যাওয়া হয় নেত্রকোনা শহরের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। সেখানে নেত্রকোনাবাসীর পক্ষ থেকে তার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানায় রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ময়মনসিংহ ও ঢাকা থেকে আসা ভক্ত-অনুরাগীরা। এরপর রাত ১১টায় বারহাট্টা রোডে নেত্রকোনা কেন্দ্রীয় মহাশ্মশানে তার শেষকৃত্য হয়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন