হেভি মেটাল মানেই আগ্রাসী লিরিকস, ভারী গিটার রিফ, যুদ্ধের দামামার মতো উচ্চলয়ে বেজে চলা ড্রামস, মেঘনাদের মতো গা শিউরে ওঠা কণ্ঠ...সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি ব্যান্ড, ব্ল্যাক সাবাথ। ব্ল্যাক সাবাথের গানে ছিল আতঙ্ক, বিদ্রোহ, হতাশা আর ছক ভাঙা সুরের বিস্ফোরণ। আর এই ব্যান্ডের সম্মুখভাগে যে মানুষটি ছিলেন, যিনি ভয়কে করেছিলেন ভয়হীন, তিনিই অজি অসবর্ন।

ব্ল্যাক স্যাবাথ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট হিসেবে তিনি কেবল রক সংগীত নয়, গোটা বিশ্বসংগীতকেই এক নতুন পরিচয়ে অভিষিক্ত করেন। বিশ্বখ্যাত অনেক রক আইকন ও সংগীত বিশ্লেষকই তাই একবাক্যে স্বীকার করেন, ‘অজি না থাকলে হেভি মেটাল নামের ঘরানাটারই জন্ম হতো না।’
বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ও সবথেকে ধনী মেটাল ব্যান্ড ‘মেটালিকা’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ফ্রন্টম্যান জেমস হেটফিল্ড এক মার্কিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অজি ছিল আমাদের সময়ের দৈত্য। ওর মতো গলায় অন্ধকার নামাতে পারত না কেউ। ও না থাকলে আমরা থাকতাম না।’

নিউ ইয়র্কভিত্তিক সংগীত সমালোচক লরেন্স গ্যার্নার বলেন, ‘সত্তরের দশকে যখন রক ধীরে ধীরে হালকা সুরে গড়াতে শুরু করছিল, ব্ল্যাক স্যাবাথ তখন ঝড় তুলেছিল অন্ধকার, ওজনদার শব্দের মূর্ছনায়। অসবর্নের কণ্ঠে ছিল হাহাকার আর বিদ্রোহ, যেটা এই ঘরানার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।’
আরেক রক ইতিহাসবিদ টম পিটারসন বলেন, ‘অজি সেই নাম, যাকে বাদ দিলে হেভি মেটালের বংশবৃক্ষটাই তৈরি হয় না।’ যুক্তরাজ্যের ‘এনএমই’ সাময়িকীতে সংগীত বোদ্ধা হ্যানা মিলার লেখেন, ‘ব্ল্যাক সাবাথ একটা বিপ্লব। আর সেই বিপ্লবের প্রধান সৈনিক ছিলেন অজি। তিনি ভয়কে গানে পরিণত করেছিলেন।’
গ্রাঞ্জ ব্যান্ড ‘পার্ল জ্যাম’-এর গিটারিস্ট মাইক ম্যাকক্রেডি সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ‘অজির কণ্ঠই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল মেটাল সংগীতের জগতে, যেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। এই সংগীত আমাকে জীবনের গভীরে নিয়ে গেছে।’

বিশ্বখ্যাত সংগীত বিশ্লেষক ডেভ মার্শ একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘ব্ল্যাক সাবাথের হাত ধরেই রক সংগীত থেকে জন্ম নেয় হেভি মেটাল। কিন্তু ব্যান্ডটা যেভাবে সেই আঁধারের ভাষা খুঁজে পেয়েছিল, সেটা সম্ভব হয়েছিল অজির গলার জন্যই।’
এমনকি ‘স্লিপনট’-এর কণ্ঠশিল্পী কোরি টেলরও বলেন, ‘অজির ছায়া ছাড়া হেভি মেটাল কল্পনা করাও যায় না। ও শুধু একজন শিল্পী ছিল না, ছিল একটা স্কুল।’

১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া ব্ল্যাক সাবাথের আত্মনামক অ্যালবাম ‘ব্ল্যাক সাবাথ’ দিয়েই শুরু হয় হেভি মেটালের যাত্রা। এরপর ‘প্যারানয়েড’, ‘মাস্টারস অব রিয়েলিটি’, ‘সাবাথ ব্লাডি সাবাথ’-একটি একটি অ্যালবাম যেন হেভি মেটালের এক একটি মাইলফলক হিসেবে পরিচিতি পায়। অজির কণ্ঠে সেই সুর হয়ে ওঠে একেকটা ঘোষণাপত্র।
সংগীতবোদ্ধা অ্যালেন লাইট এক লেখায় বলেন, ‘হিপি যুগের হালকা ভালোলাগার লাইটওয়েইট রক মিউজিক থেকে বেরিয়ে এসে যারা সত্যিকারের গর্জন চেয়েছিল, তাদের জন্য ব্ল্যাক সাবাথই ছিল একমাত্র পথ। আর অজি ছিলেন সেই পথের দ্রষ্টা।’
অজির প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে, এলটন জন পর্যন্ত বলেন, ‘সে ছিল আমার প্রিয় পাগল। একজন আসল কিংবদন্তি।’ একসঙ্গে করেন ‘অরডিনারি ম্যান’-্নামক কালজয়ী গান।

এখনও যখন নতুন কোনো ব্যান্ড হেভি মেটাল ঘরানায় আত্মপ্রকাশ করে, তখন তাদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে যে নামগুলো ঘুরে ফিরে আসে, তার মধ্যে শীর্ষেই থাকেন অজি। হয়তো সংগীত ঘরানার নাম হেভি মেটাল হতো, কিন্তু তার আত্মা, তার বিপ্লবী সত্তা, হয়তো জন্ম নিত না অজি না থাকলে।
অজি অসবর্ন চলে গেছেন, কিন্তু তার তৈরি করা হেভি মেটাল নামের এই ঘরানা আজও বেঁচে আছে। গর্জে ওঠা গিটারের শব্দে, কনসার্টে হাজার মানুষের স্লোগানে, আর প্রজন্মের পর প্রজন্মের কানে বাজতে থাকা সেই কণ্ঠে। বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজ হেভি মেটাল সংগীত যেখানে এসে দাড়িয়েছে, সেখান থেকে কান পাতলেই যেন দূর থেকে ভেসে আসে ‘প্রিন্স অব ডার্কনেস’-এর ক্রেজি ট্রেইন গানের সেই অট্টহাসি, ‘অল আবর্ড...হা হা হা!’
আপনার মতামত লিখুন :