হৃৎপিণ্ড অসুখী হচ্ছে, অথচ আমরা টেরও পাচ্ছি না- ঠিক এমনটাই ঘটছে আজকাল লাখো মানুষের জীবনে। সকালে অফিস, দুপুরে ব্যস্ততা, সন্ধ্যায় আড্ডা- সবই চলছে স্বাভাবিক মতো। কিন্তু এর মাঝেই নীরবে জমতে থাকে চাপ, ক্লান্তি আর অদৃশ্য ক্ষয়। কোনো বুকে ব্যথা নেই, হাঁপ ধরার অনুভূতি নেই, ঘামও আসে না। অথচ ঠিক এই নীরবতার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে বড় বিপদ।
দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় এক কোটি মানুষের স্বাস্থ্য রেকর্ড বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানালেন চমকপ্রদ তথ্য- হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের প্রায় ৯৯ শতাংশ রোগীর মধ্যেই আগে থেকে উপস্থিত ছিল একই চার ঝুঁকি। কোনো বংশগত কারণ নয়, কোনো অদ্ভুত জিনগত সমস্যা নয়- বরং আমাদের অগোচরে থাকা দৈনন্দিন অভ্যাস ও সংখ্যার বৈকল্যই তৈরি করছে ভয়াবহ বিপদ।
হৃদরোগের ঝুঁকির চারটি কারণ তুলে ধরা হলো-
উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্যের ওপর অদৃশ্যভাবে ক্ষতি করে। রক্তচাপ ১৩০/৮০–এর ওপরে থাকলেই ধমনীর দেয়ালে চাপ বাড়ে, ধমনী শক্ত হতে শুরু করে এবং হৃদ্যন্ত্র অতিরিক্ত চাপের মধ্যে পড়ে।
গবেষকদের মতে, হার্ট অ্যাটাকের আগেই রক্তচাপ অস্বাভাবিক ছিল- এমন রোগীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। যেহেতু উচ্চ রক্তচাপের কোনো দৃশ্যমান লক্ষণ থাকে না, তাই এটিকে ‘সাইল্টে কিলার’ বলা হয়।
উচ্চ কোলেস্টেরল
রক্তে খারাপ (এলডিএল) কোলেস্টেরল বাড়লে ধমনীতে প্লাক জমা হতে থাকে। এই প্লাক ধমনীর ভেতর রক্তপ্রবাহ কমিয়ে ধীরে ধীরে ব্লকেজ সৃষ্টি করে। এর ফলেই একসময় হৃদ্যন্ত্র অকস্মাৎ রক্তসঞ্চালন হারায় এবং ঘটে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক। দীর্ঘমেয়াদি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ না থাকাই হৃদ্রোগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।
রক্তে অতিরিক্ত শর্করা
রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়লে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস বা ধমনীর ভেতরে চর্বি- কোলেস্টেরল জমার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ধমনীগুলো ক্রমে সরু হয়ে রক্তপ্রবাহ কমে আসে। ব্লকেজ যদি তীব্র হয়, তবে মুহূর্তেই হতে পারে প্রাণঘাতী হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক। এই কারণে ডায়াবেটিস রোগীরা সবসময় উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন।
ধূমপান
ধূমপান শরীরের রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বাড়ায়, ভালো কোলেস্টেরল কমায় এবং রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে নিকোটিন রক্তনালির দেয়ালে ক্ষতি করে, যা রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হৃদ্যন্ত্র ও মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন হঠাৎ কমে যেতে পারে। ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে তাই হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।
এই চারটি কারণে নীরবে ক্ষয় হয় হৃদ্যন্ত্রের ভেতরে, আর তখনই ঘটে অস্বাভিক সেই ঘটনা? যখন রক্তচাপ, কোলেস্টেরল বা রক্তে শর্করা সামান্য বেড়ে যায়, তখন অনেকেই তা গুরুত্ব দেন না। কিন্তু ঠিক এই সামান্য সংখ্যার বিচ্যুতিগুলোই বছরের পর বছর ধমনীর ভেতর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষতি করে, যা চোখে পড়ে না। শুরুতে শরীর সেই ক্ষতি মেরামত করে নিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই ক্ষয় জমতে জমতে ভেঙে পড়ে হৃদ্যন্ত্র। তখনই হঠাৎ ঘটে যায় মারাত্মক ঘটনা।
নারীরাও সমান ঝুঁকিতে
গবেষণায় উঠে এসেছে- ৬০ বছরের কম বয়সী নারীদের ক্ষেত্রেও ৯৫ শতাংশ ঘটনার আগে অন্তত একটি ঝুঁকি ছিল। এর মানে, নারীদের হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হওয়ার গল্পের পেছনেও নীরবে চলা ঝুঁকিগুলোর দীর্ঘ ইতিহাস থাকে। তাই নারীদের জন্যও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হৃদ্যন্ত্রকে সুস্থ রাখতে কী করবেন
হৃদ্যন্ত্র সুস্থ রাখতে নিয়মিত রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও রক্তে শর্করা পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি ইসিজি, ইকো, স্ট্রেস টেস্ট বা প্রয়োজনে অ্যাঞ্জিওগ্রাম ও কার্ডিয়াক এমআরআই করানো উচিত। জীবনযাপনের পরিবর্তন- যেমন নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য, কম তেল–ঝাল–নুন, পর্যাপ্ত ঘুম এবং ধূমপান সম্পূর্ণ ত্যাগ-হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে সবচেয়ে কার্যকর।

