সুপারি এরিকাসিয়া পরিবারের এরিকা গণের লম্বা ও সরু পামজাতীয় গাছ। এর গোলাকৃতি শক্ত বীজ পানের সঙ্গে কুচি করে বা খালি খাওয়া হয়। নেশা উদ্রেককারী এই সুপারি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, চীন প্রভৃৎতি দেশে সুপারি চাষ করা হয়।
বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায়, বিশেষ করে বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার প্রভৃতি জেলায় প্রচুর সুপারি জন্মে। উত্তরবঙ্গের রংপুরেও সুপারির চাষ হয়। বাগান আকারে, বাড়ির আশপাশে বা পুকুরের ধারে সাধারণত সুপারিগাছ লাগানো হয়।
সুপারি সাধারণত পান পাতার সাথে খাওয়া হয় এবং এটি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত হয়। যদিও এটি একটি জনপ্রিয় অভ্যাস। সুপারির বেশকিছু পুষ্টিগুন রয়েছে।
সুপারির পুষ্টিগুণ (প্রতি ১০০ গ্রাম)
শক্তি (ক্যালোরি): প্রায় ৩৪০ কিলোক্যালোরি
প্রোটিন: ৫-৭ গ্রাম
চর্বি : ১০-১৫ গ্রাম
শর্করা (কার্বোহাইড্রেট): ৫০-৬০ গ্রাম
আঁশ (ফাইবার): ১৫-২০ গ্রাম
খনিজ পদার্থ: আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস
কিছু সক্রিয় উপাদান:
অ্যালকালয়েড: এটা একটি উত্তেজক পদার্থ, যা স্নায়ু তন্ত্রে প্রভাব ফেলে।
ট্যানিন: যেটা মুখগহ্বর ও দাঁতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
সুপারি চারা তৈরির জন্য কিছু ধাপে কাজ করতে হয়। নিম্নে ধাপে ধাপে সুপারি চারা তৈরির পদ্ধতি দেওয়া হলো:
সুপারি চারা তৈরির পদ্ধতি
বীজ নির্বাচন: সুস্থ, পরিপক্ব এবং রোগমুক্ত সুপারির ফল বেছে নিতে হবে। সাধারণত গাছ থেকে পড়ে যাওয়া ফল নয়, গাছ থেকে তুলে আনা পরিপক্ব ফল ব্যবহার করা উত্তম।
বীজ প্রস্তুতি: পরিপক্ব সুপারির ফল সংগ্রহ করে কিছুদিন শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর ফল থেকে বাইরের খোলস বা পাল্প সরিয়ে শুধু বীজ রাখুন। ভালোভাবে পরিষ্কার করে ৫-৭ দিন ছায়ায় শুকিয়ে নিতে পারেন।
বীজ রোপণ (নার্সারি বেডে): ছায়াযুক্ত ও সুনিষ্কাশিত জমি বেছে নিতে হবে। ১৫-২০ সেন্টিমিটার গভীর করে সারি তৈরি করতে হবে। সারিতে বীজগুলো অনুভূমিকভাবে বা সামান্য খাড়া করে (বীজের অগ্রভাগ উপরের দিকে) প্রায় ৪-৫ ইঞ্চি দূরত্বে লাগাতে হবে। মাটি দিয়ে ঢেকে দিন এবং নিয়মিত জল দিতে হবে। আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
চারা পরিচর্যা: বীজ রোপণের ৪-৬ সপ্তাহের মধ্যে অঙ্কুরোদগম হয়। চারাগুলোকে পর্যাপ্ত ছায়া ও আর্দ্রতা দিতে হয়। প্রয়োজনে জৈব সার যেমন পচানো গোবর বা কম্পোস্ট দেয়া যেতে পারে।
চারা স্থানান্তর (রোপণ): সাধারণত চারা ১২-১৮ মাস পরে জমিতে রোপণের উপযুক্ত হয়। চারার উচ্চতা ১.৫-২ ফুট হলে রোপণ করা উচিত। মূল জমিতে রোপণের আগে ভালোভাবে গর্ত করে জৈব সার মিশিয়ে প্রস্তুত করতে হবে।
সুপারি দিয়ে নানা ধরনের পণ্য ও উপকরণ তৈরি হয়, বিশেষ করে খাদ্য, ঐতিহ্যবাহী ওষুধ এবং হস্তশিল্পে। নিচে কিছু প্রধান ব্যবহার দেওয়া হলো:
সুপারি দিয়ে কী তৈরি হয়
পান-সুপারির মিশ্রণ: সবচেয়ে প্রচলিত ব্যবহার হলো পান পাতার সাথে সুপারি খাওয়া। সাধারণত চুন, জর্দা, মিষ্টি উপাদানসহ পান খাওয়া হয়, যেটা দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিতে প্রচলিত।
সুপারি গুঁড়ো / চূর্ণ: শুকনো সুপারি গুঁড়া করে বিভিন্ন ভেষজ পণ্যে ব্যবহার করা হয়। অনেকে এটিকে দাঁতের মাজন বা হজমে সহায়ক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করেন।
ঔষধি ব্যবহার (আয়ুর্বেদ ও ইউনানি): আয়ুর্বেদে সুপারিকে হজম শক্তি বৃদ্ধিকারী, কৃমিনাশক ও মুখশুদ্ধিকারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইউনানি চিকিৎসায় এটি উত্তেজক, টনিক, ও বায়ুনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
নেশাজাতীয় উপাদান: কিছু অঞ্চলে সুপারিকে জর্দা বা অন্যান্য নিকোটিন জাতীয় পদার্থের সাথে মিশিয়ে চিবানো হয়।
হস্তশিল্প ও অলংকার: শুকনো সুপারির খোল বা শাঁস দিয়ে মাঝে মাঝে হস্তশিল্প বা গহনা তৈরির ক্ষুদ্র কারুশিল্পও তৈরি হয়।
সুপারির নির্যাস: কসমেটিক ও ভেষজ পণ্যে সীমিত পরিসরে সুপারির নির্যাস ব্যবহার করা হয়। যেমনঃ মুখ ধোয়ার লিকুইড বা হারবাল পেস্টে।
সুপারির কিছু উপকারিতা আছে, তবে তা সীমিত মাত্রায় গ্রহণ করলেই উপকারী হতে পারে।
সুপারির উপকারিতা
হজমে সহায়ক- অনেকেই খাওয়ার পরে সুপারি চিবিয়ে থাকেন, কারণ এটি লালারস বৃদ্ধি করে এবং হজমে সহায়তা করে বলে বিশ্বাস করা হয়।
কৃমিনাশক হিসেবে- আয়ুর্বেদ মতে, সুপারি অন্ত্রের কৃমি দূর করতে সহায়ক হতে পারে।
উত্তেজক ও উদ্দীপক- এতে অ্যালকালয়েড নামক একটি উপাদান থাকে, যা হালকা মানসিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। ফলে কিছু মানুষ ক্লান্তি বা অবসাদ কাটাতে এটি ব্যবহার করে।
ওষুধি ব্যবহার- সুপারি ব্যবহৃত হয় মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে, হজমশক্তি বাড়াতে ও গ্যাস কমাতে। কখনো কখনো এটি পেট পরিষ্কারে সহায়ক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
মুখগহ্বর পরিষ্কারে সহায়তা- কিছু মানুষ দাঁতের মাজন হিসেবে ব্যবহার করে; যদিও এটি দাঁতের রং নষ্ট করতে পারে।
সুপারি খাওয়ার অনেক গুরুতর অপকারিতা রয়েছে, বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি ও নিয়মিত ব্যবহারে। যদিও কিছু লোক এটি হজম বা অভ্যাসগত কারণে খায়, তবুও এর স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেশি।
সুপারি খাওয়ার অপকারিতা
মুখের ক্যানসার: সুপারিতে থাকা অ্যালকালয়েড নামক রাসায়নিক পদার্থ মুখের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যানসারসৃষ্টিকারী উপাদান।
ওরাল সাবমিউকাস ফাইব্রোসিস: মুখের ভেতরে চামড়া শক্ত হয়ে যায়, ফলে মুখ খোলা, খাওয়া ও কথা বলায় সমস্যা হয়। এটি ভবিষ্যতে ক্যানসারে রূপ নিতে পারে।
দাঁত ও মাড়ির ক্ষতি: দাঁতের রং বাদামি বা লালচে হয়ে যায়। দাঁতের এনামেল নষ্ট হয়ে দাঁত ভেঙে যেতে পারে। মাড়ি ক্ষয়ে যেতে পারে এবং মুখে দুর্গন্ধ হয়।
নেশা বা আসক্তি তৈরি: সুপারির মধ্যে থাকা উপাদানগুলো ধীরে ধীরে মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে এবং আসক্তি তৈরি করে। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে ছাড়া কঠিন হয়ে পড়ে।
হৃদরোগের ঝুঁকি: সুপারি রক্তচাপ বাড়াতে পারে এবং হৃদযন্ত্রে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর।
গর্ভবতী নারীর জন্য ক্ষতিকর: সুপারি খাওয়ার কারণে গর্ভাবস্থায় শিশুর ওজন কম হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। গর্ভপাতের আশঙ্কাও বাড়ে।
পাকস্থলীর সমস্যা: অতিরিক্ত সুপারি গ্যাস্ট্রিক, আলসার ও হজমের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে
আপনার মতামত লিখুন :