বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, ‘সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মিথ্যার সঙ্গে লড়াই করা। এ জন্য সাংবাদিকদের হতে হবে সৎ, সাহসী এবং নিষ্ঠাবান।’
রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে গাজীপুর প্রেসক্লাবের তত্ত্বাবধায়ক কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ এবং ‘চব্বিশ-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গাজীপুর প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক সভাপতি খন্দকার গোলাম সরওয়ার এবং সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক মাজহারুল ইসলাম মাসুম।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ সোহেল হাসান, গাজীপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী, সাংবাদিক দেলোয়ার হোসেন, শরীফ আহমেদ শামীম, শাহ শামসুল হক রিপন, খায়রুল ইসলাম, বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, মুকুল কুমার মল্লিক, শেখ আজিজুল ইসলাম, রেজাউল বারি বাবুল প্রমুখ।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ, আর সাংবাদিকরা সমাজের ওয়াচডগ। অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন, গুম-খুন, দুর্নীতি, শিশু নির্যাতন এবং অধিকার হরণের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের সোচ্চার থাকতে হয়। চোখ রাঙানো ও ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে সাহসিকতার সঙ্গে সত্য প্রকাশ করাই সাংবাদিকতার মূলমন্ত্র।’
তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে বস্তুনিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে হবে। সাংবাদিকতা কোনো দলের বা গোষ্ঠীর নয়, এটি মানুষের অধিকার রক্ষার একটি শক্তিশালী মাধ্যম।’
বিএফইউজে মহাসচিব বলেন, ‘গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। অন্য তিনটি স্তম্ভ দুর্বল হলেও গণমাধ্যম যদি শক্ত থাকে, রাষ্ট্র গণমুখী থাকে। আর গণমাধ্যম দুর্বল হলে রাষ্ট্র বিপদে পড়ে। তথ্যই শক্তি, আর গণমাধ্যম হলো সেই শক্তির আধার।’
তিনি বলেন, ‘আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন বলেছিলেন, যদি তাকে সংবাদপত্রবিহীন সরকার এবং সরকারবিহীন সংবাদপত্রের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তবে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রই বেছে নেবেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের সরকারগুলো এখনো এই সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে।’
সাগর-রুনি হত্যার বিচার না হওয়া প্রসঙ্গে কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন ১২১ বার পেছানো হয়েছে। এটি শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য লজ্জার বিষয়। আজও কেন এই হত্যার বিচার হয়নি?’
সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কোনো আইন নেই এ বিষয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধে ৩২টি আইন রয়েছে, অথচ সাংবাদিকদের সুরক্ষায় নেই কোনো কার্যকর আইন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো কালো আইন এখনো বহাল। আমরা এসব আইনের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই আন্দোলন করে আসছি।’
কাদের গনি বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে হলুদ সাংবাদিকতা, অপসাংবাদিকতা, দলদাস সাংবাদিকতা ও তথ্য সন্ত্রাস সাংবাদিকতার গৌরব ম্লান করে দিচ্ছে। প্রকৃত সম্পাদকরা আজ কোণঠাসা, বগল সম্পাদকদের দাপটে। কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তার সহায়তায় এই ভুঁইফোড় সাংবাদিকদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে সাংবাদিকতা বলতে ছিল তোষামোদ, সরকারের পক্ষের কথা বলা। সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। সত্য তুলে ধরার অপরাধে ৬৮ জন সাংবাদিককে প্রাণ দিতে হয়েছে, সাগর-রুনির মতো সাংবাদিকদের খুন হতে হয়েছে।’
আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন দুটি সূর্য উদিত হয়—একটি প্রাকৃতিক সূর্য, অপরটি সংবাদ। সূর্যের আলোয় আমরা দেখি আর সংবাদ আমাদের চোখে আনে বিশ্বের বাস্তবতা। এই সংবাদই পারে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে।’
সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধতার আহ্বানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘সাংবাদিকতা থেকে সততা ও পেশাদারিত্ব শব্দ দুটি হারিয়ে গেলে সাংবাদিকতা নিজেই বিলুপ্ত হবে। সাংবাদিকদের জন্য একটি নিরাপদ ও স্বাধীন পরিবেশ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি, যাতে তারা ভয়মুক্তভাবে নিরপেক্ষ সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করতে পারেন।’
শেষে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমের পরাজয় মানে রাষ্ট্রের পরাজয়। তাই সাংবাদিকদের দায়িত্ব হলো সত্য প্রকাশে আপসহীন থাকা। সাহসিকতাই সাংবাদিকতার আসল পরিচয়।’