ঢাকা: পতিত সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা ছিলেন ধনঞ্জয় কুমার দাস। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব (১৫০৮৯) হিসেবে যোগ দেন তিনি। সরকারের অনুমোদনের পর দেশজুড়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদায়ন ও বদলির অর্ডার হতো তার স্বাক্ষরে। টানা প্রায় পাঁচ বছর ছিলেন এই দায়িত্বে। সোনার হাঁসের ডিম দেওয়ার মতো পদটিতে যোগ দিয়ে তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। এই স্বল্প সময়েই তিনি হয়েছেন অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক। তবে তার এই অবৈধ আয়ের সামান্য অংশ রেখেছেন দেশে। বাকিটা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়া ও ভারতে। এসবের কারণে ধনঞ্জয়কে পুলিশে বদলি-বাণিজ্যের ‘মহারাজা’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন ব্যাচমেট ও অন্য পেশার বন্ধুরা।
আলোচিত কর্মকর্তা মহারাজা ধনঞ্জয় কুমার দাস ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব হিসেবে যোগদান করেন। টানা চার বছর আট মাস পর ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর তাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে বদলি করা হয়। তবে সেই সোনর ডিমের তাড়নায় মাত্র তিন মাসেই ২০২৩ সালের ২০ মার্চ ফিরে আসেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে। এ সময় তাকে যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এই পদে থেকেও অধস্তনদের দিয়ে চালাতেন বদলি বাণিজ্য। নতুন করে ফিরে আসার পর ৫ আগস্ট পর্যন্ত অর্থাৎ আরও এক বছর চার মাস সোনার ডিম ধরার সব প্রক্রিয়া চলমান রাখেন ধনঞ্জয়। তবে এতে ছন্দপতন হয় সরকারের পতনে। নচেত আরও পাঁচ বছর জননিরাপত্তা বিভাগে থেকে এক দশক পূর্ণ করতেন ক্ষমতাধর এই কর্মকর্তা। 
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ধনঞ্জয় কুমার দাস থাকতেন জগন্নাথ হলে। পদ-পদবি না থাকলেও সক্রিয় ছিলেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। লক্ষ্মীপুরে জন্ম নেওয়া এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা তার অবৈধ আয়ের সামান্য অংশ রেখেছেন দেশে। বাকিটা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়া ও ভারতে। দেশে রাখা সামান্য অংশে রয়েছে একাধিক বাড়ি, বিলাসবহুল গাড়িসহ বিপুল সম্পদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ধনঞ্জয় কুমার দাস পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। লেনদেনে অমিল হলেই প্রত্যাহার হতেন, পদায়িত হতেন নতুন কর্মকর্তা। সবকিছুই করতেন ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের অনুমোদনে। অবশ্য প্রত্যাহার ও নতুন পদায়নের অনুমোদন নিতে ধনঞ্জয়কে খুব একটা বেগ পেতে হতো না।
জনশ্রুতি রয়েছে, জেলায় পুলিশ সুপার (এসপি) পদায়নে ১ থেকে ৩ কোটি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সিনিয়র এএসপি) ও এএসপি পদায়নে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হতো তাকে। এর অবশ্য সিংহভাগই যেত আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায়। বাকি অংশটা ধনঞ্জয়সহ পঞ্চপান্ডবের চার কুতুব ভাগ করে নিতেন। তিনি পদায়নের অর্ডারে স্বাক্ষর দেওয়ার বদৌলতে প্রতি মাসে ৬৪ জেলা থেকে পেতেন বিশেষ মাসোহারা। পেতেন ডিআইজিদের রেঞ্জ কার্যালয় থেকেও। এভাবেই তিনি জিরো থেকে হিরো হয়েছেন। শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন ২০০৫ সালে সহকারী কমিশনার হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা ২১তম বিসিএসের এই কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর ৩১ আগস্ট ধনঞ্জয়কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বদলি করা হয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের রেশম উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক হিসেবে। পরদিন ১ সেপ্টেম্বর তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অবমুক্ত করা হয়। নতুন কর্মস্থলে তিনি আর যোগ দেননি। কোনো ধরনের ছুটি না নিয়ে ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি অনুপস্থিত রয়েছেন সরকারি চাকরিতে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ৫ আগস্ট থেকেই ঢাকায় গা-ঢাকা দেন ধনঞ্জয় কুমার দাস। তাকে আর কোথাও দেখা যায়নি। সর্বশেষ স্বরাষ্ট্র থেকে পাট মন্ত্রণালয়ে বদলির অফিস আদেশ জারি হওয়ার পর গত ১ সেপ্টম্বর রাতেই তার কুমিল্লা হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্য সঠিক হলে তিনিই সরকারের প্রথম কোনো যুগ্ম সচিব, যিনি অভ্যুত্থানের পর নতুন কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে পালিয়ে গেছেন বিদেশে।
৫ আগস্টের আগেও সাম্প্রদায়িক উসকানির অভিযোগ উঠেছিল ধনঞ্জয় কুমার দাসের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তার এমন অপকর্ম তুলে ধরা হয়। ‘তিনি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ও কট্টর ইস্কনপন্থী’ ২০২২ সালের ১০ এপ্রিলে সরকারের একটি গোপন প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে নিজেই মাঠে ছিলেন বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যে উঠে এসেছে।
গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার প্রতিবাদে স্বামীবাগ থেকে বিপুল লোকজন সমবেত হয়েছিলেন শাহবাগে। এ ক্ষেত্রে নেপথ্যে থেকে যারা কলকাঠি নেড়েছেন, তাদের একজন ছিলেন ধনঞ্জয় কুমার দাস।
গতকাল এই রিপোর্ট লেখার সময় ধনঞ্জয় কুমার দাসের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন