রাখাইন রাজ্যে সম্ভাব্য ‘মানবিক করিডর’ স্থাপন নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি।
আলোচনার কেন্দ্রে- বাংলাদেশ কি মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ছায়াযুদ্ধে (প্রক্সি ওয়ার) লিপ্ত হচ্ছে, না কি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি মানবিক উদ্যোগে কারিগরি সহায়তাকারী একটি রাষ্ট্র হিসেবে ভূমিকা রাখছে?
এ বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ কোনো ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো পক্ষের সঙ্গে কোনো চুক্তি করেনি, বরং যে প্রচার চলছে, তা নিছক গুজব ও অপপ্রচার।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনবিষয়ক এক সেমিনারে ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা মানবিক করিডর নিয়ে কোনো আলোচনা করিনি, কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, কোনো পক্ষের সঙ্গে সমঝোতাও হয়নি।’
তবে তিনি পরিষ্কার করেছেন, ‘মানবিক সহায়তা চ্যানেল’ বিষয়টি ভিন্ন এবং তা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হলে বাংলাদেশ কারিগরি সহায়তা দিতে আগ্রহী।
রাখাইনে মানবিক সংকট ও করিডর প্রসঙ্গ
মিয়ানমারের সামরিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’ রাখাইন রাজ্যের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেখানে ঘন বসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
জাতিসংঘ বলছে, প্রায় ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মহলে ‘মানবিক করিডর’ স্থাপনের প্রস্তাব ওঠে। তবে মিয়ানমারের জান্তা সরকার বাংলাদেশকে কূটনৈতিক বার্তার মাধ্যমে সতর্ক করে দিয়েছে, আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ নিয়ে তারা ‘উদ্বিগ্ন’।
জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশের অবস্থান
জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি ‘হিউম্যানিটেরিয়ান চ্যানেল’ গড়ে তোলা হলে, বাংলাদেশ তা কারিগরি ও লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত- এমন বক্তব্য দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনও।
তবে তিনি জানিয়েছেন, এতে বাংলাদেশের কিছু ‘নীতি-ভিত্তিক শর্ত’ রয়েছে।
প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ভাষায়, ‘সরকার মানবিক সহায়তার বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে করিডর নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করেনি। তবে রাখাইনের মানবিক সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের নেতৃত্বে উদ্যোগ নেওয়া হলে বাংলাদেশ সহায়তা দেবে।’
আশঙ্কা কতটা বাস্তব?
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘প্রক্সি ওয়ার’ বা ছায়াযুদ্ধে জড়ানো বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। কারণ এ ধরনের পদক্ষেপ মিয়ানমারের সেনা সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাড়াবে এবং চীন ও রাশিয়ার মতো প্রভাবশালী মিত্রদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে।
বিশ্লেষক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশ এমন এক অবস্থানে রয়েছে, যেখানে সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে বরং আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে মানবিক সহায়তার পথে এগোনোই শ্রেয়।’
তিনি যুক্ত করেন, ‘বাংলাদেশের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মা অ্যাক্ট’কে একটি কৌশলগত সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা, কারণ এতে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।’
আন্তর্জাতিক রাজনীতির পালাবদলে বাংলাদেশের ভূমিকাই মুখ্য
বর্তমানে মিয়ানমারের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। রাখাইনে সেনা সরকারের কর্তৃত্ব বলতে গেলে বিলীন। বাংলাদেশের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ এখন একদিকে নিজেদের নিরাপত্তা ও মানবিক দায়বদ্ধতা রক্ষা করা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাবে ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে না পড়া।
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মিয়ানমারের সামরিক সরকার রোহিঙ্গা সংকট, মাদক ও মানবপাচার ইস্যুতে বাংলাদেশকে বারবার প্রতারিত করেছে। এখন সেই ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতা মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ, স্পষ্ট ও আত্মবিশ্বাসী কূটনীতি।
মানবিক করিডর নিয়ে ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তিকর তথ্যের মধ্যে সরকার বারবার বলছে, বাংলাদেশ কোনো সামরিক প্রভাব বা ছায়াযুদ্ধে জড়াবে না। তবে মানবিক সহায়তা পাঠাতে জাতিসংঘের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সক্রিয় থাকতে চায়।
বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ- এ সংকটে মানবতা, কূটনীতি ও জাতীয় স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রেখে অগ্রসর হওয়া।