রবিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


বিবিসি

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৫, ০৬:৪২ পিএম

সিনাই পর্বতে মিশরের মেগা প্রকল্প, সম্পৃক্ত ইসরায়েল?

বিবিসি

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৫, ০৬:৪২ পিএম

সিনাই পর্বত স্থানীয়ভাবে জাবালে মুসা নামে পরিচিত, সেখানেই আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে মুসা (আ) কথা বলেছিলেন। ছবি- সংগৃহীত

সিনাই পর্বত স্থানীয়ভাবে জাবালে মুসা নামে পরিচিত, সেখানেই আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে মুসা (আ) কথা বলেছিলেন। ছবি- সংগৃহীত

বছরের পর বছর ধরে পর্যটকেরা স্থানীয় বেদুইন গাইডের সঙ্গে সিনাই পর্বতে উঠে সূর্যোদয়ের দৃশ্য উপভোগ করেছেন। অনেকে আবার অন্যান্য বেদুইনের নেতৃত্বে হাইকিংয়ে গেছেন এই নির্মল, পাথুরে ভূদৃশ্যে। কিন্তু এখন ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের কাছে সমানভাবে সম্মানিত মিশরের অন্যতম পবিত্র স্থানটি ঘিরে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। কারণ, এটিকে একটি নতুন পর্যটন মেগা-প্রকল্পে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে মিশর।

মিশরের সিনাই উপদ্বীপে তুরে সিনার অবস্থান। এই সিনাই উপদ্বীপে তুরে সিনাকেন্দ্রীক হযরত মুসা (আ.) জীবনের বড় অংশ অতিবাহিত করেন। স্থানীয়দের কাছে ‘জাবালে মুসা’ নামে পরিচিত সিনাই পর্বতকে বাইবেল ও কোরআনের বর্ণনা করা হয়েছে।

দুই ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, এই পাহাড়ের চূড়ায় আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথন করেছিলেন নবী হযরত মুসা (আ.)। আর সেখানেই তিনি আল্লাহর কাছ থেকে বিভিন্ন সময় নির্দেশনা পেয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ত্বীন নামে একটি সূরা রয়েছে। এই সূরাতে ওয়া তূরি ছীনিন একটি আয়াত রয়েছে। যার অর্থ বুঝায় সিনাই প্রান্তরস্থ তূর পর্বত। এখানে পরবর্তী আয়াতে ওয়া হা-যাল বালাদিল আমিন। এই নিরাপদ নগরীর।

এই পবিত্র স্থানেই রয়েছে ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ পরিচালিত সেন্ট ক্যাথেরিন মঠ। গ্রিসের চাপের মুখে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ মঠটি বন্ধ করার পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে। তবে মঠ, শহর ও পর্বত মিলিয়ে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী এই মরুভূমি এলাকায় কীভাবে আধুনিক রূপ দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে এখন গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কারণ সেখানে ইতোমধ্যে বিলাসবহুল হোটেল, ভিলা ও শপিং বাজার নির্মাণ শুরু হয়েছে।

এলাকাটি ঐতিহ্যবাহী বেদুইন সম্প্রদায় জেবেলিয়া উপজাতিরও আবাসস্থল। সেন্ট ক্যাথেরিনের অভিভাবক হিসেবে পরিচিত এই উপজাতির অনেক বাড়িঘর ও ইকো-ক্যাম্প ইতোমধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে, খুব কম বা কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই। এমনকি নতুন গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা তৈরি করতে স্থানীয় কবরস্থান থেকে মরদেহ পর্যন্ত সরাতে বাধ্য করা হয়েছে।

২০২৪ সালে এল-রাহার সমভূমিতে নির্মাণাধীন একটি হোটেল। ছবি- সংগৃহীত

সিনাই উপজাতিদের সঙ্গে কাজ করা ব্রিটিশ ভ্রমণ লেখক বেন হফলার মনে করেন, এই প্রকল্পটিকে বাইরে থেকে টেকসই উন্নয়ন হিসেবে প্রচার করা হলেও বাস্তবে এটি বেদুইনদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার ভাষায়, ‘এটি জেবেলিয়ারা যেমনটা দেখতে চেয়েছিল তেমন উন্নয়ন নয়, বরং স্থানীয় স্বার্থের চেয়ে বাইরের স্বার্থ রক্ষার জন্য চাপিয়ে দেওয়া এক পরিকল্পনা।’ বাইরের স্বার্থ বলতে ইসরায়েলের দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘যাযাবর ঐতিহ্যের একটি বেদুইন উপজাতিকে ঘিরে গড়ে তোলা হচ্ছে এক নতুন নগর জগৎ, যার সঙ্গে তারা কখনও থাকতে চায়নি, যার নির্মাণে তাদের সম্মতি নেই, অথচ এটি তাদের জন্মভূমিতে তাদের অবস্থানকে স্থায়ীভাবে বদলে দেবে।’

স্থানীয় চার হাজার বাসিন্দা পরিবর্তন নিয়ে প্রকাশ্যে খুব একটা কিছু বলছেন না। তবে গ্রিসই এখন পর্যন্ত মিশরের পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় সমালোচক। গত মে মাসে এক আদালতের রায়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সক্রিয় খ্রিস্টান মঠ সেন্ট ক্যাথেরিনকে রাষ্ট্রীয় জমিতে অবস্থিত বলে ঘোষণা করা হলে এথেন্স ও কায়রোর মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। কয়েক দশক ধরে চলা বিরোধের পর আদালত জানায়, মঠটির শুধু জমি ও পার্শ্ববর্তী প্রত্নতাত্ত্বিক ধর্মীয় স্থানের ‘ব্যবহারের অধিকার’ রয়েছে, মালিকানা নয়।

এ রায়ের তীব্র সমালোচনা করেন গ্রিসের চার্চ প্রধান আর্চবিশপ দ্বিতীয় ইয়েরোনিমোস। তিনি বলেন, ‘মঠের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। অর্থোডক্সি ও হেলেনিজমের এই আধ্যাত্মিক আলোকবর্তিকা এখন অস্তিত্ব সংকটে।’ এক বিরল সাক্ষাৎকারে মঠের আর্চবিশপ ড্যামিয়ানোসও একে ‘গুরুতর আঘাত ও অপমান’ বলে মন্তব্য করেন। এ বিষয়টি মঠের ভেতর সন্ন্যাসীদের মধ্যেও তিক্ত বিভেদ তৈরি করেছে, ফলে তিনি সম্প্রতি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

অন্যদিকে, জেরুজালেমের গ্রিক অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ার্কেট জানিয়েছে, পবিত্র এই স্থানটিকে নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) স্বয়ং সুরক্ষার একটি চিঠি দিয়েছিলেন। তাদের মতে, বাইজেন্টাইন যুগের মঠটি (ফাতেমি আমলে নির্মিত একটি ছোট মসজিদও রয়েছে) খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে শান্তির প্রতীক এবং সংঘাতে জর্জরিত বিশ্বের জন্য আশার আশ্রয়স্থল।

যদিও বিতর্কিত রায় বহাল আছে, তবে গ্রিস ও মিশরের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনার ফল হিসেবে একটি যৌথ ঘোষণাপত্রে সেন্ট ক্যাথেরিনের গ্রিক অর্থোডক্স পরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।

‘বিশেষ উপহার’ নাকি অযাচিত হস্তক্ষেপ?

মিশর ২০২১ সালে পর্যটকদের জন্য রাষ্ট্র-স্পন্সরিত ‘গ্রেট ট্রান্সফিগারেশন প্রকল্প’ শুরু করে। এর আওতায় হোটেল, ইকো-লজ, বৃহৎ দর্শনার্থী কেন্দ্র, কাছাকাছি ছোট বিমানবন্দর এবং মাউন্ট মোজেস পর্যন্ত কেবল কার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকার একে ‘সমগ্র বিশ্ব ও সব ধর্মের জন্য মিশরের উপহার’ হিসেবে বর্ণনা করছে। গৃহায়নমন্ত্রী শেরিফ এল-শেরবিনি বলেন, এই উন্নয়ন দর্শনার্থীদের পূর্ণ সুবিধা দেবে, সেন্ট ক্যাথেরিন ও আশপাশের এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে, পরিবেশ ও ঐতিহ্য রক্ষা করবে এবং প্রকল্পে কাজ করা লোকদের আবাসনের ব্যবস্থাও করবে।

তবে তহবিলের ঘাটতির কারণে কাজ সাময়িকভাবে থেমে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবু সেন্ট ক্যাথেরিন মঠের সামনে এল-রাহার সমভূমি ইতোমধ্যেই নতুন রাস্তা ও অবকাঠামোর মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে। এ স্থানেই মুসা (আ.) আল্লাহর সঙ্গে কথা বলার জন্য সিনাই পর্বতচূড়ায় গেলে ইসরায়েলিরা তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় তাদের একজন সোনার বাছুর তৈরি করেছিল এবং পুরো গোত্র তার পূজা করে বিপদগামী হয়েছিল।

সমালোচকরা বলছেন, এসব উন্নয়নের ফলে অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ইউনেস্কো সাইটটির অসামান্য ঐতিহ্যের বর্ণনায় বলেছে, ‘রুক্ষ পাহাড়ি ভূদৃশ্য মঠের জন্য এক নিখুঁত পটভূমি তৈরি করেছে’। তাদের মতে, এর অবস্থান প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মানুষের আধ্যাত্মিক প্রতিশ্রুতির মধ্যে এক গভীর যোগসূত্র।

২০২৪ সালে এল-রাহা সমভূমিতে নির্মাণ কাজ। ছবি- সংগৃহীত

২০২৩ সালে ইউনেস্কো মিশরকে উন্নয়ন বন্ধ করে প্রভাব যাচাই ও সংরক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান জানালেও তা কার্যকর হয়নি। চলতি বছরের জুলাইতে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ওয়াচ’ ইউনেস্কোর কমিটির কাছে সেন্ট ক্যাথেরিনকে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানায়। এ নিয়ে প্রচারকরা সেন্ট ক্যাথেরিন ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষক ব্রিটেনের রাজা চার্লসের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। তিনি স্থানটিকে ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের যোগ্য আধ্যাত্মিক সম্পদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

এটাই প্রথম নয়, মিশরের বড় উন্নয়ন পরিকল্পনা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি সংবেদনশীলতার অভাবের জন্য সমালোচিত হচ্ছে। কিন্তু সরকার মনে করছে, এসব মেগা-প্রকল্পই দুর্বল অর্থনীতি ঘুরিয়ে দাঁড় করানোর মূল চাবিকাঠি। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে শুরু করলেও গাজা যুদ্ধ ও আঞ্চলিক অস্থিরতার ধাক্কা সামলাতে পর্যটন খাতকে নতুন করে উজ্জীবিত করা জরুরি। সরকার ২০২৮ সালের মধ্যে ৩ কোটি পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য ঘোষণা করেছে।

দক্ষিণ সিনাইতে শার্ম আল-শেখসহ লোহিত সাগরের জনপ্রিয় গন্তব্যগুলোর মতো এখানেও বেদুইনদের পরামর্শ ছাড়াই উন্নয়ন হচ্ছে। ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের সময় ইসরায়েল এই উপদ্বীপ দখল করে। বেদুইনরা অভিযোগ করে আসছে, ১৯৭৯ সালের শান্তি চুক্তির পর উপদ্বীপ মিশরের হাতে ফেরত যাওয়ার পর থেকেই তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো দেখা হয়।

১৯৮০-এর দশকে পর্যটনশিল্প প্রসারের সময় বেদুইনরা প্রথমে গাইড, শ্রমিক ও ভাড়াটে কর্মী হিসেবে কাজ করলেও পরে পর্যটন ব্যবসা থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হয়। সাংবাদিক মোহান্নাদ সাবরির ভাষায়, ‘তাদের শুধু ব্যবসা থেকেই নয়, সমুদ্রতীর থেকেও পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল’। নতুন সেন্ট ক্যাথেরিন উন্নয়নেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে অর্থাৎ দেশের অন্য অঞ্চল থেকে কর্মী আনার পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও সরকার দাবি করছে, তারা বেদুইন আবাসিক এলাকাগুলোকেও উন্নত করছে।

দেড় সহস্রাব্দ ধরে সেন্ট ক্যাথেরিন মঠ অসংখ্য উত্থান-পতন সহ্য করেছে। কিন্তু তখনও এটি ছিল এক দূরবর্তী আশ্রয়স্থল। লোহিত সাগরের রিসোর্ট সম্প্রসারণের পর বিপুল সংখ্যক তীর্থযাত্রী আসতে শুরু করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভিড় এতটাই বেড়েছে যে অনেকেই জ্বলন্ত ঝোপের ধ্বংসাবশেষ ঘেঁটে দেখছে কিংবা কোডেক্স সিনাইটিকাস প্রদর্শনীতে ভিড় করছে, যা বিশ্বের প্রাচীনতম হাতে লেখা নিউ টেস্টামেন্টের কপি।

Link copied!