ঢাকা শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৫

‘জান্নাতে খাবার পাওয়ার আশায় নিজেদের মৃত্যু চায় গাজার শিশুরা’

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৫, ১১:১৩ পিএম
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় খাবারের আশায় শিশুদের ভিড়। ছবি- সংগৃহীত

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি নিয়ে হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের জ্যেষ্ঠ মিডিয়া ম্যানেজার শাইমা আল-ওবাইদি। খাবারের অভাবে থাকা শিশুদের মুখে তিনি বলতে শুনেছেন, তারা মরে যেতে চায়, যেন জান্নাতে গিয়ে কিছু খেতে পারে।

সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে শাইমা বলেন, ‘গত ২ মার্চ রমজান মাসে হঠাৎ করে ত্রাণ সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এর আগের দিন অফিসে আনন্দঘন পরিবেশ ছিল, কারণ বাজারে অনেক দিন পর লেটুস পাওয়া গিয়েছিল এবং কর্মীরা আলোচনায় মেতে উঠেছিলেন, সেদিন ইফতারে কী সালাদ তৈরি করবেন তা নিয়ে।’

শাইমা আরও বলেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যেই কোনো ধরনের প্রোটিন বা মাংস পাওয়া যাচ্ছিল না। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে গেল টাটকা ফল ও শাকসবজি। এক মাস যেতে না যেতেই ময়দা পাওয়া বন্ধ হলো। আর কোথাও যদি ময়দা থাকত, তার দাম স্বাভাবিকের তিনগুণ ছিল।’

তিনি আরও জানান, মানুষ ঘাস-পাতা খেতে বাধ্য হচ্ছিল। শিশুদের মুখে তিনি শোনেন, তারা নিজেদের মৃত্যু চায়, যাতে জান্নাতে গিয়ে খেতে পারে।

অন্যদিকে গাজা শহরের বাসিন্দা ইউসরা আবু শারেখ বর্তমানে দুই সন্তানকে নিয়ে চরম খাদ্যসংকটে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ফর এইড, রিলিফ অ্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্স-এর গাজা প্রোগ্রামের কো-অর্ডিনেটর।

বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের নিউজআওয়ারে তিনি জানান, গাজার প্রায় সবাই অপুষ্টিতে ভুগছে। টানা পাঁচ মাস ধরে মাংস, ডিম ও ফলের মতো পুষ্টিকর খাবারের নাগাল পাচ্ছে না মানুষ। শারেখ বলেন, ‘শিশুরাই এই সংঘাতে সবচেয়ে বড় মূল্য দিচ্ছে।’

শারেখের ৭ বছর বয়সি ছেলে অপুষ্টির শিকার। তিনি বলেন, ‘ও শুধু রুটি খেয়ে বাঁচতে পারবে না, শুধু পাস্তা খেয়ে বাঁচতে পারবে না—এটাই আমাদের সীমিত খাদ্য। এটা আমাকে ভেতর থেকে মেরে ফেলছে।’

এদিকে, গাজায় দুর্ভিক্ষ চলছে বলে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে জাতিসংঘের একটি সংস্থা। জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) বলছে, তারা গাজার খাদ্য পরিস্থিতিকে সর্বোচ্চ ধাপ ফেজ-৫-এ উন্নীত করেছে, যা দুর্ভিক্ষ, অনাহার ও মৃত্যুর সংকেত দেয়। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকার পাঁচ লাখের বেশি মানুষ বিপর্যয়কর অবস্থায় রয়েছে, যেখানে ক্ষুধা ও মৃত্যু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

তবে ‘ইসরায়েল’ বলছে, আইপিসির প্রতিবেদন হামাসের মিথ্যা প্রচারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। দেশটি এখনো গাজায় সাহায্য প্রবেশে কড়াকড়ি জারি রেখেছে এবং বারবার দুর্ভিক্ষের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। এই দাবি জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা, শতাধিক মানবিক সংগঠন ও মাঠ পর্যায়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

আইপিসি তাদের প্রতিবেদনে এই দুর্ভিক্ষকে ‘সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছে এবং সতর্ক করেছে—অবিলম্বে বড় আকারে পদক্ষেপ না নিলে দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হওয়া প্রথম দুর্ভিক্ষ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়বে দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনিসে। ওই সময় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা (প্রায় ৬ লাখ ৪১ হাজার মানুষ) ফেজ-৫ পরিস্থিতিতে পড়বে। একইসঙ্গে ফেজ-৪-এ থাকা মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১১ লাখ ৪০ হাজারে পৌঁছাতে পারে।

জাতিসংঘের ত্রাণ-বিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার বলেছেন, এই দুর্ভিক্ষ সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা যেত। কিন্তু ‘ইসরায়েল’র কৌশলগত বাধার কারণে গাজায় খাবার পৌঁছাতে পারেনি।

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘গাজার জীবন্ত নরককে বর্ণনা করার মতো শব্দ যখন আর বাকি ছিল না, তখন নতুন একটি শব্দ যুক্ত হলো—দুর্ভিক্ষ।’ তিনি একে ‘মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ও মানবতার ব্যর্থতা’ হিসেবে আখ্যা দেন।

গুতেরেস আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ‘ইসরায়েল’র খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।”

এই প্রতিবেদন প্রকাশ হলো এমন সময়ে যখন ‘ইসরায়েল’ নতুন করে গাজা সিটি দখলের সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বাধীন আক্রমণে দক্ষিণ ‘ইসরায়েলে’ প্রায় ১ হাজার ২০০ জন মানুষ নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এরপর থেকেই গাজায় ‘ইসরায়েলি’ সামরিক অভিযান চলছে।

হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত গাজায় অন্তত ৬২ হাজার ১২২ জন নিহত হয়েছেন। গাজার জনসংখ্যার বেশিরভাগই বহুবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে; ৯০ শতাংশের বেশি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে; স্বাস্থ্য, পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।