ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫

জলে গেলো ২৫ কোটি টাকা

সিলেট ব্যুরো ও দক্ষিণ সুরমা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২৫, ০১:১২ এএম

নয় একরের বিশাল জায়গাজুড়ে ট্রাক টার্মিনাল। ধারণক্ষমতা ১২০০। উদ্বোধনের পর অতিবাহিত হয়েছে প্রায় ৬ বছর। কিন্তু এই সময়ে টার্মিনালে ১২০০ ট্রাকও ঢোকেনি। উল্টো সেই টার্মিনাল এখন পরিণত হয়েছে অপরাধের স্বর্গরাজ্যে। সড়কের সামনে দাঁড়িয়ে ‘কল্যাণ ফান্ডের’ নামে চলে দিনভর চাঁদাবাজি।

সন্ধ্যা নামলেই ভিড় বাড়ে মাদকসেবীদের। রাতভর চলে মাদকের কেনাবেচা। গভীর রাত অবধি আড্ডা জমে হেরোইনসেবীদের। তারা এই টার্মিনালকে মাদকের হাটে পরিণত করেছে। এমনকি অনেক অপরাধী এখানে এসে তাদের অপরাধ পরিকল্পনার ছক আঁকে। ‘ট্রাকের বিশ্রামাগার’ হলেও সিলেট কেন্দ্রীয় ট্রাক টার্মিনালটি এখন রীতিমতো অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে টার্মিনালটি নির্মাণ করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। উদ্বোধন হয় ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর। উদ্বোধনের পর থেকেই কার্যত অচল হয়ে পড়ে আছে। না আছে এটি কার্যকর করার উদ্যোগ, না আছে সংরক্ষণের চেষ্টা। অবহেলার কারণে বিশাল ব্যয়ে নির্মিত টার্মিনালটি কোনোভাবেই রাজস্ব আয়ের উৎস হয়ে উঠতে পারছে না। বরং পরিচিতি পাচ্ছে ‘সিসিকের ক্ষত’ হিসেবে।

এই টার্মিনাল ট্রাকের জন্য নির্মাণ করা হলেও সেখানে কোনো ট্রাক প্রবেশ করে না। ফলে রাজস্বও আদায় হয় না। শুরুর পর একমাত্র কোরবানি ঈদের সময় ইজারা দেওয়া ছাড়া আর কোনো আয় নেই টার্মিনাল থেকে। গত কোরবানির ঈদে এই টার্মিনাল ‘কোরবানির পশুর হাট’ হিসেবে ইজারা দিয়ে সিসিক আয় করেছিল ২৫ লাখ টাকা। সারা বছরে আয় বলতে ওইটুকুই।

সিলেট শহরতলির দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ রোডে অবস্থিত টার্মিনালটি পড়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায়। মালিকানাও সিটির। তবে তার প্রতি কোনো যতœ নেই।

সিলেটের ট্রাক শ্রমিক নেতাদের মতে, ট্রাক টার্মিনাল কোনো মতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই টার্মিনাল থেকে বছরে কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতো। সিলেট জেলা ট্রাক-পিকআপ কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের দক্ষিণ সুরমা শাখার সহ-সভাপতি জুমেল আহমদ বলেন, ট্রাক টার্মিনালটি শহর থেকে অনেক দূরে নির্মাণ করা হয়েছে। আশপাশে কোনো খাবারের হোটেল নেই। রুচিসম্মত বিশ্রামের জায়গা নেই। ওয়ার্কশপ নেই। গাড়ির চাকার সামান্য বাতাস মিলাতে হলে আসতে হয় শহরে।

খাবার খেতে হলেও অনেক টাকা খরচ করে শহরে গিয়ে খেতে হয়। অনেকটা মরুভূমির মতো অবস্থা। ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে সেখানে। এসব সমস্যা সমাধান না করলে এই টার্মিনাল থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। এর জন্য সিটি করপোরেশনকেই উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবহন নেতারা ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি নয়, সারা দেশের মতোই কল্যাণ ফান্ডের টাকা তোলার দাবি করেন। একে তারা ‘চাঁদাবাজি’ বলতে নারাজ। 

সরেজমিন দেখা যায়, বিশাল ট্রাক টার্মিনালটি ফাঁকা পড়ে আছে। সিটি করপোরেশনের একটি গাড়ি ছাড়া আর কোনো ট্রাক সেখানে নেই। তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে চালক ও সহকারীদের বিশ্রামকক্ষ ও শৌচাগার। মাকড়সার জাল চারদিকে। টার্মিনালের যখন এই অবস্থা, তখন তার পাশেই সিলেট বাইপাসে, সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট-ঢাকা রোডগুলোর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যত্রতত্র পার্কিং করে দাঁড়িয়ে আছে ট্রাকের সারি। এগুলোই থাকার কথা ছিল ট্রাক টার্মিনালে। কিন্তু সেখানে ট্রাক নিয়ে যাচ্ছেন চালকরা। ফলে আশপাশে সব সময়ই লেগে থাকছে যানজট। 

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খালি  মাঠে চালকরা ট্রাক নিয়ে যাবেন না। চালকদের আহার ও বিশ্রামের সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে তারা সেখানে ট্রাক পার্কিং করবেন। তারা জানান, রাতের বেলা সেখানে অন্য রকম পরিবেশ তৈরি হয়। নিরাপত্তার অভাবও রয়েছে। চোর ও মাদকসেবীদের উৎপাত তাদের আরও আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। ছিনতাই হয় হরহামেশাই। 

তবে সিলেট সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সব দাবি সঠিক নয়। টার্মিনাল কম ব্যবহার হচ্ছে এটি ঠিক, কিন্তু আধুনিক সুবিধা নিয়েই টার্মিনালটি সেবা দেওয়ার জন্য তৈরি রয়েছে। যেসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগে যাচ্ছে সিলেট সিটি করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, চালকদের বিশ্রামের সুব্যবস্থা টার্মিনালে রয়েছে। রেস্তোরাঁ ও ওয়ার্কশপ ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে। চালকরা সেখানে গাড়ি নিয়ে না গেলে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে কীভাবেÑ প্রশ্ন তোলেন তারা। 

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে। তিনি ট্রাকচালকদের টার্মিনালে ট্রাক নিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেন। রাতে টার্মিনালে মাদকের হাট বসে বলে কোনো তথ্য তিনি জানেন না বলে জানান।