দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোটের নতুন মেরুকরণ আলোচনায় আসে ১৯৯৭ সালে। ওই বছর প্রতিষ্ঠা পায় বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বহু খাতভিত্তিক কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক উদ্যোগ বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন)।
বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন দুয়ার খুলতে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবারের বিমসটেক সম্মেলন। আসছে শীর্ষ সম্মেলনে বাণিজ্য সম্ভাবনা বৃদ্ধির সুযোগ খুঁজবেন ৭ দেশের শীর্ষ নেতারা। সমঝোতা হতে পারে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল ও সমুদ্র পরিবহন নিয়ে।
সংস্থাটির ভবিষ্যৎ নিয়েও কর্মপরিকল্পনা দেবে বিশিষ্টজনদের একটি কমিটি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিমসটেকে সীমাবদ্ধ না থেকে বাংলাদেশের সামনে এখন আসিয়ান অঞ্চলে সম্পর্ক জোরদারের হাতছানি। পাশাপাশি, রাজনৈতিক জোট হিসেবেও আগামীতে সক্রিয় হতে পারে সংস্থাটি।
জানা যায়, দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক প্রতিষ্ঠা পায় আশির দশকের মধ্যভাগে। ভারত ও পাকিস্তানের রেষারেষির প্রভাবে আঞ্চলিক এই জোটের কার্যকারিতা কিংবা সম্ভাবনা কমে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোটের নতুন মেরুকরণ আলোচনায় আসে ১৯৯৭ সালে। ওই বছর প্রতিষ্ঠা পায় বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বহু খাতভিত্তিক কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক উদ্যোগ বিমসটেক।
আগামীকাল শুক্রবার থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন। এই সম্মেলন উপলক্ষে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আজ বৃহস্পতিবার ব্যাংককে অনুষ্ঠিতব্য ২০তম বিমসটেকের মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় অংশগ্রহণ করবেন।
এছাড়া এবারের বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের আগে আজ বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘বিমসটেক ইয়াং জেনারেশন ফোরাম : হয়্যার দ্য ফিউচার মিটস’ শীর্ষক ফোরামে কি-নোট স্পিকার হিসেবে বক্তব্য রাখবেন।
বাংলাদেশ ছাড়াও বিমসটেকের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল ও থাইল্যান্ড। বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন থেকেই বিমসটেকের পরবর্তী সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন প্রধান উপদেষ্টা।
বিমসটেকের কার্যক্রম নিয়ে বিগত ২৮ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আঞ্চলিক অর্থনীতিসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই জোটও সার্কের মতো পথ হারাবে। তারা বলছেন, বিমসটেকবিষয়ক নানা পরিকল্পনা ও আলোচনা এগোয়।
সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রাজনীতিবিদদের মধ্যে পরিকল্পনাগুলোর নীতিগত দিক নিয়ে মতৈক্যও দেখা দেয়। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে সেই ঐকমত্যের প্রতিফলন হয় না। এ পরিস্থিতির উজ্জ্বল উদাহরণ ২০০৪ সালে স্বাক্ষর হওয়া বিমসটেক-মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট। আসন্ন বিমসটেক সম্মেলনেও চূড়ান্তভাবে এফটিএ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
সার্কের বিকল্প জোট হিসেবে বিমসটেক বা এ দুই সংস্থার তুলনামূলক আলোচনায় অগ্রহী নন অনেক বিশেষজ্ঞ ও কূটনীতিক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট হিসেবে সার্কের তেমন কোনো অর্জন নেই।
অন্যদিকে বিমসটেককে একটি কার্যকর ও গতিশীল সংগঠনে পরিণত করতে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্যে ফারাক রয়ে গেছে। ফলে বিমসটেকও সার্কের মতো পথ হারাতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সার্ক এখন আর একেবারেই কার্যকর নেই। সার্ক নিয়ে উৎসাহও অনুপস্থিত সদস্য দেশগুলোয়। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ বিবেচনায় বিমসটেক নিয়ে রাজনৈতিক উৎসাহ ছিল এবং এখনো আছে।
১৯৯৭ সালে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এই সংস্থার দুই সদস্য দেশ মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড আসিয়ানেরও সদস্য। সুতরাং দক্ষিণ এশিয়া ও আসিয়ানের মধ্যে একটা মেলবন্ধনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করার একটা লক্ষ্য ছিল বিমসটেক প্রতিষ্ঠার সময়।
বিমসটেক-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ২০০৪ সালে বিমসটেক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর হয়েছিল। এই চুক্তি ঘিরে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো চ’ড়ান্ত ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর হয়নি।
এছাড়া বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করা হয়েছে যেমন- পরিবহনসংক্রান্ত মহাপরিকল্পনা। এর মাধ্যমে বাণিজ্য, যোগাযোগ ও বিনিয়োগের একটা ত্রিমাত্রিক সংশ্লেষ করার সুযোগ ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ উদ্দেশ্যে এমিন্যান্ট পারসনস গ্রুপ গঠন করা হয়েছিল। তাদের প্রতিবেদন নিয়ে আসন্ন সামিটেও আলোচনা হবে। কিন্তু ২৮ বছরে বিমসটেক যে গতিতে অগ্রসর হয়েছে, তাতে এবারের সম্মেলন নিয়ে আশাবাদী হতে পারছেন না পর্যবেক্ষকেরা।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা জানি না এটা (বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল ও সমুদ্র পরিবহন নিয়ে সমঝোতা) স্বাক্ষর করার মতো অবস্থায় থাকবে কি না।
কিন্তু এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমরা যদি শূন্য শুল্ক-সুবিধা পরস্পরের মধ্যে পেতে পারি, সেটার সুযোগে আমরা যদি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারি। বিমসটেক মার্কেটে আমরা শূন্য শুল্ক-সুবিধাটা নিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে পারি।
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের সভাপতি এম হুমায়ুন কবীর বলেছেন, বিমসটেক আগামী কিছুদিন কীভাবে চলবে তার একটা দিকনির্দেশনার ব্যাপার আছে। একটা ডিক্লারেশন থাকার কথা বলা হচ্ছে।
এছাড়া বিমসটেক কেমন চলছে, এসডিজি নিয়ে এই অঞ্চল কতটা অগ্রগতি করতে পেরেছে, কীভাবে পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানো যায়, গ্লোবালাইজেশনের যে প্রক্রিয়াটা আছে, এটাকে কীভাবে আরও ইনক্লুসিভ করা যায়।
আঞ্চলিক রাজনৈতিক জোট হিসেবেও গুরুত্ব বাড়ছে বিমসটেকের। তাই বহুপাক্ষিক এই সম্মেলনের সাইডলাইনে দ্বিপাক্ষিক বেশ কিছু বৈঠক সেরে ফেলতে পারেন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতারা। এমনকি মিয়ানমারের জান্তা সরকার প্রধানের সঙ্গে প্রথমবারের মতো বৈঠক হতে পারে অনেক নেতার।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও আমরা দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা শুরু করেছি। সেটা ঠিক আছে। বিমসটেকের প্রধান কার্যালয় বাংলাদেশে অবস্থিত। তাই এখানে আমাদের একটা ন্যাচারাল এডভেন্টাজ থাকার কথা।
এম হুমায়ুন কবীর বলেন, আস্থার জায়গাটা তৈরি হলে সম্পর্কটা স্বাভাবিক জায়গায় আসতে পারে এখানে। তারা ওখানে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করবে, আমি তা মনে করছি না। পারস্পরিকভাবে যদি তারা একে-অপরের ওপর আস্থা বোধ করেন, তাহলে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে বলে আমার ধারণা। আমাদের দিক থেকে তো আমরা উদ্যোগী হয়েই আছি।
বিমসটেক ঢাকা কার্যালয় জানিয়েছে, বিমসটেকের ১৫টি খাতভিত্তিক ব্যাপক কর্মসূচি রয়েছে এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও গড়ে উঠেছে। এটি নিজস্ব চার্টার বা সনদ পেয়েছে এবং শিগগিরই নিজস্ব ভিশন ডকুমেন্ট ও নিয়মাবলি পাবে।
সব সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণের প্রতিশ্রুতি থাকায় প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রের সমান মর্যাদা ও ভূমিকা নিশ্চিত হয়। প্রত্যেক সদস্যদেশকে নির্দিষ্ট একটি বা একাধিক খাতে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা আঞ্চলিক সহযোগিতায় সব সদস্যের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছে।
বিমসটেক ঢাকা কার্যালয় জানিয়েছে, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব প্রদান সদস্য দেশগুলোর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে।
এছাড়া দ্বিপক্ষীয় বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক ইস্যু থেকে দূরে থাকার ঐতিহ্য সংস্থাটির আসল শক্তি, যা সদস্য দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ রেখে প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়ন ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহায্য করছে।
গত ১২ মার্চ বিমসটেকের ঢাকা কার্যালয়ে আসন্ন সামিট নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার, গ্লোবাল চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড বিমসটেক শীর্ষক উপস্থাপনা পেশ করেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
তার গবেষণায় সংস্থাটির যে চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে বলা হয়, তার মধ্যে ছিল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ঘাটতি, সদস্য দেশগুলোর স্থায়ী প্রতিশ্রুতির অভাব, সনদ গ্রহণে দীর্ঘ বিলম্বের (২৫ বছর) ফলে সীমিত প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, স্বল্প আঞ্চলিক বাণিজ্য, অবকাঠামোগত ঘাটতি, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন, যেমন- বাংলাদেশ-মিয়ানমার, সম্পদের সীমাবদ্ধতা বা অপর্যাপ্ত তহবিলপ্রাপ্ত সচিবালয় ও দক্ষ জনবলের অভাব।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বাধা প্রসঙ্গেও উল্লেখ ছিল সেলিম রায়হানের উপস্থাপনায়। সেখানে বলা হয়, ২০০৪ সালের কাঠামো থাকা সত্ত্বেও এফটিএ বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কার্যকর হয়নি। এফটিএর চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে সংবেদনশীল পণ্যের তালিকা নিয়ে বিরোধ, অশুল্ক বাধা, প্রতিরক্ষামূলক নীতি ও অর্থনীতিকে উদারীকরণে অনীহা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে বিমসটেক সম্মেলন শীর্ষক ব্রিফিং। সেখানে পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন বলেন, ‘এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এবারের ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন নতুন বাংলাদেশের জন্য বিমসটেকের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক অঙ্গনে নতুন পদচারণা। এবারের সম্মেলন আমাদের জন্য দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশকে উপস্থাপনের সুযোগ এনে দেবে।
আমি বিশ্বাস করি, এবারের সম্মেলন বাংলাদেশ ও অন্যান্য বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ককে আরও দৃঢ় ও গভীর করবে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও উন্নয়ন এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ দুই বছরের জন্য বিমসটেকের সভাপতিত্ব গ্রহণ করবে বিধায় এবারের বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
 

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন