ঢাকা শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫

শিক্ষকদের আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় দুই কোটি শিক্ষার্থী

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২৫, ০৮:৪৬ এএম
ছবি - সংগৃহীত

বেতন বৃদ্ধি, গ্রেড উন্নয়ন, জাতীয়করণ ও এমপিওসহ নানা দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকরা টানা আন্দোলন ও কর্মবিরতি পালন করায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা পর্যায়ের প্রায় দুই কোটির বেশি শিক্ষার্থী। করোনাকালীন শিখন ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার আগেই বারবার কর্মসূচির কারণে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও পাঠদানে তৈরি হয়েছে মারাত্মক ব্যাঘাত। বিশেষত বার্ষিক পরীক্ষার পূর্বমুহূর্তে কর্মবিরতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

প্রাথমিকে বড় সংকট

বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিসংখ্যান ২০২৪ অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ কোটি ৬ লাখ ১৭ হাজার ৯৬২ জন। চলতি বছরেও প্রায় একই সংখ্যা রয়েছে। শিক্ষা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষক আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা এখন অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে।

চাকরির শুরুতে ১১তম বেতন গ্রেড নির্ধারণসহ তিন দফা দাবিতে গত মঙ্গলবার থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি শুরু করেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের এক গ্রুপ। তিন দফাগুলো হলো- দশম গ্রেড, দ্রুত স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠনসহ অন্যান্য দাবি—প্রাথমিকের শিক্ষকরা এ বছর তিন দফায় কর্মবিরতিতে গেছেন। প্রথম দফা ছিল ২৬ মে, দ্বিতীয় দফা ৯–১১ নভেম্বর এবং তৃতীয় দফার প্রাথমিক শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। দাবি পূরণ না হলে পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণাও দিয়েছেন তারা।

প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দীন বলেন, পুলিশের হামলায় একজন শিক্ষক নিহত এবং দেড় শতাধিক আহত হওয়ার পরও সরকারের প্রতিশ্রুতির কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি। ফলে আবারও কর্মবিরতিতে যেতে হয়েছে।

১০ম গ্রেড নিয়ে মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১৩তম গ্রেড থেকে সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা সম্ভব নয়। এতে বছরে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হতো প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এমনকি ১১তম গ্রেড বাস্তবায়িত হলেও বছরে বাড়তি ব্যয় হবে ৮৩১ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

এছাড়া দেশে এখনো এসএসসি–এইচএসসি পাস প্রায় ৬৬ হাজার শিক্ষক কর্মরত আছেন, যাদের অবসরে যেতে আরও ১০ বছর লাগবে। তাদের অবসরের আগে দশম গ্রেড বাস্তবায়নে জটিলতা রয়েছে বলে জানায় মন্ত্রণালয়।

বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা ৩,৮৪,৯৮১ জন- এরমধ্যে প্রধান শিক্ষক ৩৫ হাজার এবং বাকিরা সহকারী। দেশে প্রাথমিক শিক্ষার্থী ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৫ জন; এর মধ্যে সরকারি বিদ্যালয়ে রয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৮১৫ জন (৫৫.৭৩শতাংশ)।

মাধ্যমিক–উচ্চ মাধ্যমিকেও দীর্ঘ আন্দোলন

বেসরকারি মাধ্যমিক–উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই এমপিওভুক্ত। বিবিএস অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের ৭৮.৮৯ শতাংশ এমপিওভুক্ত। এ স্তরে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ২৩ লাখ ৩ হাজার ৩১৬ জন- এর মধ্যে প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থী এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত।

বাড়িভাড়া বৃদ্ধিসহ তিন দাবিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ১২–২১ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ৮ দিন কর্মবিরতিতে ছিলেন। অন্যদিকে, নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ২৫ দিন ধরে রাজধানীতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন এবং যমুনা ঘেরাওয়ের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের আটকে দেয়।

ব্যানবেইস পরিসংখ্যান ২০২৩ অনুযায়ী বেসরকারি মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ৮৭ লাখ ৪১ হাজার ৪৮০ জন এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ৮ লাখ ২৬ হাজার ৪৭১ জন। সব মিলিয়ে সাধারণ শিক্ষায় (সরকারি প্রাথমিক + বেসরকারি মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক) শিক্ষার্থী ২ কোটি ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯১৩ জন।

মাদ্রাসা ও কারিগরিতেও আন্দোলনের প্রভাব

মাদ্রাসা ধারায় ইবতেদায়ি পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৬২৭ জন, দাখিলে ১৪ লাখ ৯ হাজার ৭৮৪ জন এবং আলিম পর্যায়ে ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৪১০ জনসহ মোট ৩৭ লাখ ৭৪ হাজার ৮২১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এদিকে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা ১২ অক্টোবর থেকে এক মাসেরও বেশি সময় আন্দোলন করেছেন জাতীয়করণের দাবিতে।

কারিগরি ধারায় মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৮০৪ জন এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৩৬৭ জন। প্রায় প্রতিটি স্তরেই আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীরা কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকরা কর্মবিরতি

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫ লাখ ৭১ হাজার ৬৮১। এ স্তরের সহকারী শিক্ষকরা সহকারী শিক্ষক পদকে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্তকরণ, নবম গ্রেড ধরে নতুন পদসোপান এবং স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠনের দাবি আদায়ে আগামী সপ্তাহের শুরু থেকে কর্মবিরতিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল নাহিয়ান বলেন, আর্থিক সুবিধা নয়, বরং মর্যাদার প্রশ্নে চারটি দাবি বাস্তবায়নই তাদের মূল লক্ষ্য। উচ্চ আদালতও রায় দিয়েছে, তবে সরকার তা বাস্তবায়ন করছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন, করোনাকালের শিখন ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার আগেই শিক্ষক আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে।

তিনি অভিযোগ করেন, বিগত সরকার ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেউই শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়নি এবং কোনো শিক্ষা কমিশন গঠন করেনি।

দুইস্তরের পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, পরীক্ষা সামনে রেখে আন্দোলন হলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি আরও বাড়ে।

তার মতে, শিক্ষকদের দাবিগুলো যৌক্তিক হলেও আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করা যেত।

৩০ নভেম্বর থেকে লাগাতার কর্মবিরতি

প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ ঘোষণা দিয়েছে যে, ৩০ নভেম্বর থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণদিবস কর্মবিরতি চলবে। শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থাকলেও শিক্ষকেরা ক্লাস পরীক্ষা নেবেন না। নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা না হলে দাবি আদায়ের পর ছুটির দিনে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এছাড়া ১১ ডিসেম্বর থেকে লাগাতার অনশন কর্মসূচিরও ঘোষণা রয়েছে।

৮ নভেম্বর পুলিশের হামলায় আহত শিক্ষকদের চিকিৎসা এবং নিহত শিক্ষিকা ফাতেমা আক্তারের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ ও পূর্ণ পেনশন প্রদানেরও দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।

শিক্ষা সংকট দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে

দেশের বিভিন্ন স্তরে একই সময়ে আন্দোলন ও কর্মবিরতির কারণে শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এ সংকট দ্রুত সমাধান না হলে শিক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি তৈরি হবে, যার ভার বহন করতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।