রাত গভীর। শহর তখন ঘুমে ডুবে। হঠাৎই মাটি যেন শরীরের নিচে সরে যায়—দেওয়াল কেঁপে ওঠে, জানালায় হালকা ধাক্কার শব্দ। কয়েক সেকেন্ডের এই অস্থিরতা কাটার আগেই মানুষের প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় স্মার্টফোনে হাত বাড়ানো। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হওয়ার আগেই তাদের মাথায় ভেসে ওঠে একটাই প্রশ্ন—এটা আসলে কত বড় ভূমিকম্প ছিল? এই উত্তরের খোঁজে মুহূর্তেই তারা ঢুঁ মারেন তিন পরিচিত উৎসে—ইউরোপের ইএমএসসি, যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএস এবং বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি)। তিন প্রতিষ্ঠান, তিন প্রযুক্তি, তিন দর্শন—তবে উদ্দেশ্য একটাই, দ্রুত ও নির্ভুল তথ্য সরবরাহ।
এদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায় প্যারিসভিত্তিক ইউরোপিয়ান-মেডিটেরিনিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ইএমএসসি)। প্রচলিত সেন্সরনির্ভর ডেটার বাইরে ইএমএসসি ব্যবহার করে মানুষের আচরণ—এটাই তাদের শক্তি। মাটি কাঁপা মাত্র কোনো এলাকায় হঠাৎ বেড়ে যায় ‘ভূমিকম্প’ সার্চ, লাস্টকোয়েক অ্যাপে লগইন, সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট—এই অস্বাভাবিক ওয়েব ট্রাফিকই ইএমএসসির অ্যালগরিদমকে জানিয়ে দেয় যে কম্পন ঘটেছে। ফলে সেন্সরের তথ্য প্রসেস হওয়ার আগেই তারা গড়ে দুই মিনিটেরও কম সময়ে সতর্কবার্তা পাঠাতে সক্ষম হয়। সাধারণ মানুষও তাদের কাছে তথ্যদাতা হয়ে ওঠেন—পোস্ট করেন ছবি, ভিডিও আর ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ। ইএমএসসির মূল দর্শন, যন্ত্রের আগে মানুষই হলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সেন্সর।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএস গতির চেয়ে নির্ভুল বিশ্লেষণকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা পৃথিবীর ভূমিকম্প তথ্যের ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে পরিচিত। তাদের শেক-ম্যাপ প্রযুক্তি জানায় কোন এলাকায় ভূমিকম্পে কতটা তীব্র কাঁপন অনুভূত হয়েছে, আর পেজার সিস্টেম প্রদান করে সম্ভাব্য প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রাথমিক অনুমান। সবুজ থেকে লাল রঙের সতর্ক সংকেতে বোঝা যায় বিপর্যয়ের মাত্রা—লাল সংকেত মানে সম্ভাব্য বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা, জাতিসংঘ থেকে শুরু করে প্রকৌশলীরা পর্যন্ত উদ্ধার পরিকল্পনায় ইউএসজিএসের তথ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন।
এই বৈশ্বিক প্রযুক্তির মাঝে রয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রহরী—আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি)। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে প্রথম মানমন্দির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পথচলা শুরু করে। সময়ের সঙ্গে তারা অ্যানালগ ব্যবস্থা থেকে ডিজিটাল সিসমিক সিস্টেমে উন্নীত হয়েছে, রাডার ইন্টিগ্রেশনও করেছে। বর্তমানে আগারগাঁও, সিলেট, রংপুর ও গাজীপুরের সিসমিক অবজারভেটরি নিয়ে গড়ে উঠেছে তাদের নেটওয়ার্ক। দেশের সিসমিক জোন ম্যাপ তৈরি এবং ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড প্রণয়নেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জাতীয় পর্যায়ে ভূমিকম্প সংক্রান্ত সরকারি তথ্য সরবরাহের দায়িত্বও তাদের ওপর।
ইএমএসসির দ্রুততা, ইউএসজিএসের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং বিএমডির সরকারি নিশ্চয়তা—এই তিনটি মিলেই গড়ে ওঠে ভূমিকম্প তথ্যের পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তাবলয়। কম্পন থেমে যাওয়ার পর স্মার্টফোনের আলো জ্বলে উঠতেই মানুষ তিন উৎসে ছুটে যায়, শুধু অভ্যাসবশত নয়—নিরাপত্তার প্রয়োজনেই। ভূমিকম্প কখনো সময় জানিয়ে আসে না, কিন্তু তথ্য আসে, যদি আমরা তিন দিকেই কান খোলা রাখি।

