প্রতিদিনের মতোই বক্তব্যে কড়া, শুদ্ধ উচ্চারণে রঙ্গ-ব্যঙ্গ আর জনসংযোগে চাতুর্য- এই ছিল ওবায়দুল কাদেরের পরিচয়। তিনি নিজেই বলতেন, ‘জ্বালা রে জ্বালা, অন্তর্জ্বালা’, কিংবা ‘পালাব না, প্রয়োজনে ফখরুল সাহেবের বাসায় উঠব।’ অথচ বাস্তবতা হলো, বিএনপির মহাসচিব আজও দেশের মাটিতে রয়েছেন; আর ওবায়দুল কাদের মুখ ঢেকে কলকাতার রাস্তায় হাঁটেন।
২০১১ সালে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে পরে টানা তিনবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। দপ্তর ও দল- উভয় জায়গায় দীর্ঘস্থায়ী কর্তৃত্ব তাকে একপ্রকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। কিন্তু সেই কর্তৃত্ব গড়তে গিয়ে তৈরি করেন এক অনির্বচনীয় দুর্নীতির চক্র- যা এখন ‘কাদেরচক্র’ নামে পরিচিত।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে গড়ে ওঠা এই চক্রে ছিলেন তার স্ত্রী ইসরাতুন্নেসা, ছোট ভাই কাদের মির্জা, ভাতিজা তাশিক মির্জা, ভাগ্নে মাহবুবুর রশীদ মঞ্জু, ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বাদলসহ একাধিক আত্মীয়স্বজন। অভিযোগ আছে, সড়ক, সেতু ও বিআরটিএসহ বিভিন্ন দপ্তরে এই চক্র দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ, চাঁদাবাজি, জমিদখল ও কমিশন বাণিজ্য করেছে।
২০২৩ সালের ৫ আগস্ট ক্ষুব্ধ জনতা কাদেরের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার আগেই কাদের ও তার চক্র পালিয়ে যায় এলাকা ছাড়িয়ে।
কাদেরের স্ত্রী ইসরাতুন্নেসার প্রভাবও ছিল বিস্তৃত। তার তদবিরে বিভিন্ন কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন, এমনকি মন্ত্রীদের স্ত্রীরাও তার কাছে সুপারিশের আশায় উপহার পাঠাতেন। তার গাড়িচালক আতিকুর রহমান মানিকগঞ্জে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন একটি ভবন, যার অর্থের উৎস নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কোম্পানীগঞ্জ পৌর মেয়র কাদের মির্জা বড় ভাইয়ের পরিচয়ে পৌরসভা, বাজার, হাসপাতাল এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। ঠিকাদারি ও নিয়োগে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় ছিল তার প্রধান কার্যক্রম। বসুরহাটে দোকানপাট দখল করে পৌরসভার নামে ভাড়া আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।
কাদের মির্জা অন্যের জমি দখল করে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় নির্মাণ করেছেন। জমির মালিক নুর উদ্দিন জাহাঙ্গীর আদালতে অভিযোগ করেছেন, তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার জমি বিনামূল্যে লিখিয়ে নেওয়া হয়।
মির্জা গড়ে তোলেন ‘হেলমেট বাহিনী’ নামে সন্ত্রাসী দল, যার নেতৃত্বে ছেলে তাশিক মির্জা। ২০২১ সালের এক সংঘর্ষে সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির নিহত হন। পরিবার মামলায় নাম উল্লেখ করতে সাহস পায়নি। এই বাহিনী বিএনপির নেতাকর্মীদের ঘরবাড়িতেও হামলা চালায়।
চক্রের সদস্যদের অনেকে বর্তমানে বিদেশে পলাতক। কেউ কানাডা, কেউ দুবাই, কেউ সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। বিপুল সম্পদের মালিক এই লোকেরা কেউ রাজনৈতিক, কেউ প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে গড়ে তুলেছেন অবৈধ অর্থবিত্তের সাম্রাজ্য।
আপনার মতামত লিখুন :