বৃহস্পতিবার, ০১ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


সেলিম আহমেদ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৬, ২০২৫, ১২:৫৫ এএম

সম্মানির নামে হরিলুট

সেলিম আহমেদ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৬, ২০২৫, ১২:৫৫ এএম

সম্মানির নামে হরিলুট

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

শিক্ষা বোর্ডের নিয়ম মতে পাবলিক পরীক্ষার মূল সনদপত্র লিখন, যাচাই, স্বাক্ষর ও প্রেরণসংক্রান্ত কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সনদপ্রতি পাবেন ৬ টাকা সম্মানি। অথচ নিয়ম ভেঙে এক কর্মকর্তাকে দেওয়া হচ্ছে ছয়গুণ বেশি অর্থাৎ ৩৬ টাকা সম্মানি। এতে বছরে ৯ শিক্ষা বোর্ডের গচ্চা যাচ্ছে ৯ কোটি ৮ লাখ ১৭ হাজার ১১৯ টাকা।

শুধু তাই নয়, এসএসসির নম্বরপত্র লিখন, যাচাই, স্বাক্ষর আর প্রেরণের জন্য পরীক্ষার্থী প্রতি সাড়ে ১২ টাকার পরিবর্তে ২২ টাকা আর একই খাতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীপ্রতি ১৫ টাকার পরিবর্তে ৩৭ টাকা সম্মানি নেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এই খাতে সম্মানির নামে বছরে আরও ২ কোটি ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ২৯ টাকা নেন তারা। এভাবেই আরও ১৩ খাতে সম্মানির নামে বছরে অন্তত সাড়ে ২৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নিচ্ছেন বোর্ড কর্মকর্তারা। এর বাইরেও নানা খাতে বোর্ড কর্মকর্তাদের নয়ছয়ের কারণে বছরে আরও  সাড়ে ১২ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে সরকার ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর। শিক্ষা বোর্ডগুলোর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বিল-বাউচার ও শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের অডিট আপত্তি বিশ্লেষণে এভাবেই উঠে এসেছে সম্মানির নামে হরিলুট আর অনিয়মের চিত্র।

দেশের বর্তমানে শিক্ষা বোর্ডের সংখ্যা ১১। এর মধ্যে ৯টি সাধারণ আর দুটি বিশেষায়িত। সাধারণ শিক্ষাবোর্ডগুলো হলো- ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, সিলেট, যশোর, বরিশাল, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ। বাকি দুটি হলো- কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। ১১টি বোর্ডে কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় সাড়ে ৩ হাজার। মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া, পাসকরা শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়া, সনদের ভুলক্রটি থাকলে তা সংশোধন করা বোর্ডগুলোর প্রধান কাজ। এর বাইরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে তার পাঠদানের অনুমোদন, স্বীকৃতি দেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি দেওয়া, শিক্ষার্থীদের ভর্তিসহ সংশ্লিষ্ট আরও কিছু কাজ করে।

এদিকে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর তাদের নিরীক্ষা রিপোর্ট সম্প্রতি জমাদানকালেও জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার আবশ্যক বলে সুপারিশ করেছে। তবে শিক্ষা বোর্ডগুলো বলছে, আন্তঃশিক্ষা বোর্ড কমিটি ও সংশ্লিষ্ট বোর্ডের অর্থ কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে এ ভার্তা বা সম্মানি নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।

যেসব খাত থেকে সম্মানির নামে লুটপাট:  জানা যায়, এই দুই খাত ছাড়াও এসএসসি ও এইচএসসির পরীক্ষার উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণ কাজের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বছরে দেওয়া হয় ২ কোটি ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ২৯ টাকা সম্মানি। অথচ ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, দিনাজপুর, রাজশাহী, যশোর ও রবিশাল শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা প্রাপ্ততা না থাকলেও এই খাতটি থেকে বিপুল পরিমাণ এই সম্মানি নিচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশমতে, পরীক্ষার পূর্বপ্রস্তুতি, পরীক্ষা পরিচালনা, ফল প্রকাশ, নিবন্ধন, সনদপত্র ও নম্বরপত্র লেখার জন্য শুধু সম্মানি পাবেন। এর বাইরে কোনো কাজের জন্য তারা কোনো সম্মানি পাবেন না। অথচ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয়ক কমিটির অনুমোদনে তারা এই সম্মানি নিচ্ছেন। তবে কোন বোর্ড বছরে কত টাকা সম্মানি নিচ্ছে তা নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এ ছাড়াও প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও একাদশ শ্রেণির অনলাইন ভর্তিসংক্রান্ত কাজের জন্য বছরে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৩ হাজার ৬২০ টাকা,  এসএসসি ও এইচএসসির ব্যবহারিক পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাইয়ের জন্য ৪৬ লাখ ১৮ হাজার ৩৬৮ টাকা, জেএসসি পরীক্ষার নিবন্ধন, সনদপত্রের স্বাক্ষর ও যাচাইয়ের নামে ৪২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৭ টাকা, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার সনদে নাম ও বয়স সংশোধনী কাজের জন্য ১ কোটি ৯৯ হাজার ১০ টাকা, পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশসংক্রান্ত কাজের জন্য ১ কোটি ৪৬ লাখ ২২ হাজার ২৩৬ টাকা, পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা কাজের জন্য ১ কোটি ২৫ লাখ ৭৭ হাজার ৯৫২ টাকা, পাবলিক পরীক্ষার পূর্বপ্রস্তুতি কাজের জন্য ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬৬০ টাকা, পাবলিক পরীক্ষার নিবন্ধন কাজের জন্য ৮২ লাখ ৬৬ হাজার ৫০৮ টাকা ভাতা দেওয়া হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

শুধু তাই নায়, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপার কাজে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট প্রেসে (বিজি প্রেস) যাতায়াত ও অবস্থান দেখিয়ে ওই অর্থবছরে ১ কোটি ১ লাখ ১১ হাজার ৩২ টাকা নিয়েছেন ৮টি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অথচ ‘দ্য ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১’ অনুযায়ী, প্রশ্ন ছাপার কাজে বিজি প্রেসে যাতায়াত ও অবস্থানের জন্য কোনো ভাতার বিধান নেই।

আরও  নানা খাতে অনিয়ম, গচ্চা সাড়ে ১২ কোটি টাকা: জানা যায়, এই সম্মানির বাইরে শিক্ষা বোর্ডগুলোতে নানা খাতে অনিয়মের কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও  সাড়ে ১২ কোটি টাকার গচ্চা গেছে সরকার ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর। এই ৯ বোর্ডের মধ্যে ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের ওই অর্থবছরে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গৃহ নির্মাণ, মেরামত ও কম্পিউটার ক্রয় করার জন্য ১ কোটি ২০ লাখ ৭৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য ১০.৭৫ টাকা সুদ আদায় করার কথা। অথচ বোর্ডগুলো আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্তের অজুহাত দেখিয়ে ৫ শতাংশ হারে সুদ আদায় করছে। এতে বছরে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বোর্ডগুলোর।

এর বাইরে ঢাকা, কুমিল্লা ও রবিশাল শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন মালামাল কেনার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জন্য ৯ কোটি ৪৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮৫০ টাকা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ৯০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে মালামাল প্রদান করা কথা থাকলেও সেই সময়ে মালামাল প্রদান করতে পারেননি তারা। কেউ কেউ নির্ধারিত সময়ের থেকে ১৫ দিন বিলম্বে মালামাল সরবরাহ করেন। সরকারের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী, মালামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে বিলস্ব হলে প্রতিদিন বিলম্বের জন্য এক শতাংশ হারে বিলম্ব জরিমানা কর্তন করার কথা। কিন্তু এই ক্ষেত্রে কোনো বিলম্ব জরিমানা আদায় করা হয়নি। ফলে এই তিন বোর্ডের ৭৭ লাখ ২৭ হাজার ৫৭২ টাকা গচ্চা গেছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন কাজের জন্য ওই বছরে ৮ শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১ কোটি ৭৫ লাখ ৪৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা অগ্রিম প্রদান করা হয়। বিধিমতে, ৬ মাসের মধ্যে ওই টাকায় সমন্বয় করার কথা থাকলেও সমন্বয় করা হয়নি। ফলে পুরো টাকাই রয়ে গেছে তাদের পকেটে।

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার গোপনীয় মুদ্রণ কাজের ব্যয় নির্বাহের জন্য বিজি প্রেসকে শেয়ার মানির নামে ওই অর্থবছরে ৯৫ লাখ ৩৪ হাজার ১১৭ টাকা প্রদান করে ৯ শিক্ষা বোর্ড। কিন্তু প্রশ্নপত্র মুদ্রণ করার পর বিজি প্রেসকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। আবার শিক্ষা বোর্ডের অদ্যাদেশ অনুযায়ী, বিল পরিশোধের কোনো সুযোগও নেই। ফলে প্রাধিকার বহির্ভূতভাবে শেয়ার মানি প্রদান করা শিক্ষা বোর্ডগুলোর বিপুল অঙ্কের টাকা ক্ষতি হয়েছে।  সূত্র মতে, সিলেট ও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ওএমআরসহ মূল উত্তরপত্র, নৈর্ব্যক্তিক শিট ও ব্যবহারিক উত্তরপত্রের জন্য প্রাক্কলিত মূল্য উপেক্ষা করে অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করার ১ কোটি ৬৪ লাখ ৬৪ হাজার ২৮০ টাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকা, দিনাজপুর, যশোর ও বরিশাল বোর্ডের বাড়ি ভাড়া, আসবাবপত্র সরবরাহ ও যানবাহন ভাড়া বাবদ ওই বছরে ১০ কোটি ৬৭ লাখ ৮৬২ টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ভ্যাট কর্তন করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখ ৫৪ হাজার ৮১০ টাকা।

এর বাইরেও কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড টেস্ট রিপোর্ট ছাড়াই অনিয়মিতভাবে ৩ কোটি ৯০ লাখ ৮২ হাজার ৫শ এবং সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বোর্ড ওই বছরে কোটেশন প্রদ্ধতিতে নির্ধারিত ক্রয়ের সিলিং অতিক্রম করে অনিয়মিতভাবে আরও ৬৪ লাখ ৬৭ হাজার ৫১ টাকা ব্যয় করেছে। 

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন: এ প্রসঙ্গে কথা বলতে বেশ কয়েকটি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি ও সংশ্লিষ্ট বোর্ডের অর্থ কমিটির অনুমোদন নিয়েই এসব ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এই ভাতা দেওয়ার রীতি দীর্ঘদিন থেকে চলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা বোর্ডগুলো তাদের নিজস্ব আইনে চলে। তবে ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশকে আরও যুগোপযোগী করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ড আইন করার কাজ চলছে। আইনটি হলে বোর্ডগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জবাবদিহির আওতায় আসবেন এবং বোর্ডে আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

আরবি/জেডআর

Link copied!