রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) গুলশানের প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্লটগুলো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
কিন্তু সেগুলো পরে বেহাত হয়ে যায়। রাজউকের দাপ্তরিক আদেশ উপেক্ষা করে এসব প্লট ও ফ্ল্যাটে ঝুলছে নতুন মালিকানার নামফলক। সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের চেষ্টা চলছে। কোথাও কোথাও নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরুও হয়ে গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সময় রাজউকের চেয়ারম্যান ছিলেন আনিসুর রহমান মিয়া। তিনি ২০২২ সালের ৪ জুন যোগদান করে ২০২৪ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন।
তার অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে গুলশানের এসব মূল্যবান প্লট ও বাড়ি মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের বরাদ্দ দেওয়া হয়। মূলত এসব প্লট ও বাড়ি রাজউকের পরিত্যক্ত ও বিতর্কিত সম্পত্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে এসব সম্পত্তি প্রভাবশালীদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে নানা নয়ছয় করে। রাজউকের তৎকালীন সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট সরকারি সম্পদ তছরুপে দিনের পর দিন মদদ দিয়ে গেছে।
জানা যায়, পরে নুরুল ইসলামের প্রত্যক্ষ প্রয়াসে এসব অনিয়ম জায়েজ ও আইনসিদ্ধ করার চেষ্টা চলে। আওয়ামী ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে তিনি টানা ছয় বছর সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) হিসেবে রাজউকে দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আওয়ামী সরকারের পতনের মাত্র কয়েক মাস আগে তাকে পদোন্নতি দিয়ে মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে নিয়ে অনেকটা দুর্বৃৃত্তপনাকে জায়েজ ও পুরস্কৃত করা হয়।
সরেজমিন : রাজউকের হস্তান্তর নিষেধাজ্ঞার তালিকার ২২ নম্বরে রয়েছে গুলশানের ৫৯ নম্বর সড়কের ২ নম্বর বাড়ি (ব্লক-এডব্লিউ-ই)। ২০ কাঠা জমিসহ বাড়িটির বর্তমান মূল্য শতকোটি টাকার ওপরে। মূল্যবান এই বাড়ির মালিকানা নিয়ে কয়েক দশক ধরে বিরোধ চলছিল।
বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, সীমানা প্রাচীর ঘেরা জরাজীর্ণ একতালা বাড়ি। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় চারদিক ঝোপঝাড়ে ভরা। জং ধরেছে মূল ফটকে। কিন্তু ফটকের পাশে চকচক করছে পাথরের তৈরি নামফলক। এতে লেখা ‘বাড়ির মালিক আসিফ মাহমুদ’। বর্তমানে পুরোনো স্থাপনা ভেঙে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে, বাইরে ঝুলছে ডেভেলপার কোম্পানির সাইনবোর্ড ‘বোরাক মিনারভা’।
রাজউকের বিতর্কিত সম্পত্তির তালিকায় আরেকটি হলো গুলশানের ১২৬ নম্বর সড়কের ২ নম্বর বাড়ি (ব্লক সিএস-ই)। প্লটের আয়তন ১৪ কাঠা। মালিকানা দ্বন্দ্বে দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকলেও এখন সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। ইতিমধ্যে পুরোনো বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, চারদিকে উঁচু সীমানা প্রাচীর। ভেতরে পোশাকধারী নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করছেন। বাড়ির মালিক কে জানতে চাইলে তারা বলেন, ক্যাথেরেসিস নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানি এখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করবে। তারা ওই কোম্পানিরই কর্মচারী। মালিক কে তারা চেনে না।
উল্লেখ্য, এই ক্যাথেরেসিসের মালিক রুহুল আমিন স্বপন সাম্প্রতিক মালয়েশিয়ায় কর্মী পাচারের সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা হিসেবে অভিযুক্ত।
আশপাশের দোকানি ও স্থানীয় মানুষ জানান, এই জমির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এ জন্য মালিক হিসেবে একেক সময় একেকজনের নাম শোনা যায়। তবে আদি মালিকের নাম মনির হোসেন।
আরেকজন দোকানি জানান, আলোচিত খুকু হত্যা মামলার অন্যতম আসামি মনির হোসেন এই প্লটের মালিক ছিলেন। কিন্তু কারাবন্দি অবস্থায় তার ফাঁসি কার্যকর হলে একাধিক ব্যক্তি মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করেন। এতে করে দীর্ঘদিন এই প্লটটি ফাঁকা পড়ে ছিল। সম্প্রতি এটি বিক্রি হয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছে।
গুলশানের ১৩৫ নম্বর সড়কে গিয়ে দেখা যায়, ১ নম্বর প্লটের বাড়িটি রাজউকের পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত। এটি বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের দখলে। সেখানে ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রস্তাবিত প্রধান কার্যালয়ের বিশাল সাইনবোর্ড ঝুলছে। বাড়ির একদিকে সশস্ত্র আনসার, অন্যদিকে নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন।
এ ছাড়া ইতিমধ্যে রাজউকের হস্তান্তরের তালিকায় আছে গুলশানের ৯৮ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর এবং ৪৯ নম্বর সড়কের (সিডব্লিইএন) ২ নম্বর বাড়ি। দুটি বাড়িই বিশাল আয়তনের প্লটে অবস্থিত। এসব প্লটের বর্তমান বাজার মূল্য কাঠাপ্রতি কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা।
অপকর্মে নুরুল চক্র: রাজউকের পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দে নয়ছয়ের নেপথ্যে ছিলেন সংস্থাটির তৎকালীন সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) নুরুল ইসলাম। মূলত তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এসব প্লট বরাদ্দ করা হয় নানা কৌশলে।
এ ছাড়া অনিয়ম জায়েজ করতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে আনা হয় বিশেষ ‘রাজনৈতিক সুপারিশ’। পরে চেয়ারম্যানসহ অন্য সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে নেওয়া হয় বিশেষ বোর্ডসভার অনুমোদন। অনেকটা প্যাকেজ আকারে সম্পন্ন হয় পুরো প্রক্রিয়া।
অনিয়মে নুরুল ছাড়াও রাজউকের বেশ কয়েকজন কর্মচারী জড়িত ছিলেন। তারা হলেনÑ নুরুরের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিএ) হুমায়ুন কবির, তৎকালীন পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) কামরুল ইসলাম, উপপরিচালক আমিরুল ইসলাম, গুলশান এস্টেট শাখার উপপরিচালক লিটন সরকার, উপপরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) এর নায়েব আলী শরীফ এবং উচ্চমান সহকারী প্রবীর কুমার সরকার।
রাজউকের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শুধু পরিত্যক্ত সম্পত্তিই নয়, রাজউকের নানা অনিয়মের হোতা ছিলেন নুরুল ইসলাম। আওয়ামী ঘনিষ্ঠ হওয়ায় টানা ৬ বছর এস্টেট ও ভূমির সদস্য হিসেবে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। নানা অনিয়মকে জায়েজ করে নিয়েছেন আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে।
নানা অনিয়মের মাধ্যমে উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে তিনি বাগিয়ে নেন ৫ কাঠা আয়তনের ৭ কোটি টাকার প্লট। প্লট-১৬, সেক্টর ১৬/এ, রোড নং-০৩। এ ছাড়া আরও একাধিক প্রমাণযোগ্য অভিযোগ এলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি দাপটের সঙ্গে বহাল থেকেছেন রাজউকে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কয়েক মাস আগে তাকে যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।
ফাইল গায়েব: রাজউকের পরিত্যক্ত বাড়িসংক্রান্ত ফাইল গায়েব হয়ে গেছে। হোল্ডিং নম্বর দেখে চমকে ওঠেন কর্মচারীরা। দীর্ঘক্ষণ খুঁজে না পেয়ে বললেন, এভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কারণ এসব কাজ কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করা হয়েছে। দাপ্তরিক কাজ শেষ হলেও নিয়মানুযায়ী এগুলোর ফাইল রেকর্ডরুমে দেওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নুরল ইসলামের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হারানো ফাইলের বিপরীতে খোলা হয় বিশেষ ‘লুজ নথি’। এ ছাড়া কয়েকটি ফাইল অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
এর কয়েকটি রয়েছে তৎকালীন পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি), বর্তমানে জোন-৪-এ বদলিকৃত কামরুল ইসলামের জিম্মায়। তার অফিসের আলমিরাতে ফাইলগুলো তালাবদ্ধ রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানার জন্য নুরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার পরিবারকে পূর্বাচলে ৬০ কাঠা আয়তনের বরাদ্ধকৃত প্লটের বিষয়ে মামলায় তিনি এখন পলাতক।

 
                            -20250304185250.webp) 
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন