বাড়তে থাকা পেটের চর্বি কমাতে অনেকে জিমের শরণাপন্ন হন। অনেকে আবার এ বিষয়টিকে খুব একটা পাত্তাই দেন না। পেটের এই অরিরিক্ত চর্বি সাধারণভাবে ‘বেলি ফ্যাট’, ‘টামি ফ্যাট’ বা ‘বিয়ার বেলি’ নামে পরিচিত। যারা নিজেদের চেহারা ও ফিটনেসের ব্যাপারে সচেতন, তারা এ নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকেন।
পেটের চারপাশে চর্বি বেড়ে গেলে মানুষ তার ইচ্ছেমতো আরাম করে পোশাক পরতে পারে না। এই চর্বি নানা দিক থেকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
পেটের চর্বি থেকে যেসব রোগ হয়
পেটের চর্বি উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে অতিরিক্ত শর্করা ও কোলেস্টেরলের সমস্যার মতো গুরুতর কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এটি টাইপ-টু ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ায়।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পেটের চর্বি শরীরে ‘সাইটোকাইন’ নামের এক ধরনের প্রোটিনের উৎপাদন বাড়ায়, যা শরীরে প্রদাহ তৈরি করতে পারে। এ ছাড়া, বেলি ফ্যাট ‘অ্যাঞ্জিওটেনসিন’ নামক আরেকটি প্রোটিনের উৎপাদনও বাড়ায়। এই প্রোটিন আবার রক্তনালীকে সংকুচিত করে ও রক্তচাপ বাড়ায়। পাশাপাশি, এই চর্বি থেকে ডিমেনশিয়া, হাঁপানি ও কিছু ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ে।
দিল্লির ফোর্টিস এসকর্টস হাসপাতালের সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ডা. শিব কুমার চৌধুরী বলেন, পেটে জমে থাকা চর্বি শরীরের অন্য অংশের চর্বির চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘যখন পেটের চর্বির কোষ ভেঙ্গে যায়, তখন সেখান থেকে নানা ধরনের বিষাক্ত উপাদান বের হয়। এগুলো হৃদপিণ্ডের ধমনীতে প্রদাহ বাড়ায়। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। এটি শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধও বাড়িয়ে দেয়। এতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, পেটের চর্বি বাড়ার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। যেমন: জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, হরমোনজনিত পরিবর্তন, বয়স, অতিরিক্ত ওজন ও মেনোপজ। এ ছাড়া অনিয়মিত জীবনযাপন, অগোছালো রুটিন ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসও এর জন্য দায়ী।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গ্রহণের মাধ্যমে সময়মতো পেটের চর্বি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পেটের চর্বি কমাতে যেসব বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে, তা এখানে তুলে ধরা হলো।
রাতের খাবার ও ঘুমানোর সময়ের ব্যবধান
ঘুমানোর আগে অন্তত দুই থেকে তিন ঘণ্টা কিছু খাওয়া যাবে না। দিনে যেসব খাবার খাওয়া হয়, শরীর সেগুলোর ক্যালরি দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে ও শক্তি উৎপাদন করে। কিন্তু রাতের খাবারের পর আর এগুলো ব্যবহৃত হয় না। ফলে সেগুলো চর্বি হিসেবে জমে যায় এবং ওজন বাড়তে শুরু করে।
সুষম খাদ্য গ্রহণ
বিশেষজ্ঞরা বলেন, খাবারে বেশি ফাইবার থাকলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা থাকে। ফাইবারযুক্ত খাবার পাকস্থলীতে দীর্ঘসময় থাকে এবং অন্ত্রে খাবার যাওয়ার গতি ধীর করে দেয়। এতে ক্ষুধা কম লাগে এবং বারবার খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। তাই, খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন রাখতে হবে। প্রোটিন দীর্ঘসময় পেট ভরা রাখে, ক্ষুধা কমায় এবং ঘ্রেলিন নামের ক্ষুধা বাড়ানো হরমোনের মাত্রা কমায়।
প্রোটিন মাংসপেশি শক্তিশালী করে এবং বিপাকক্রিয়াকেও ত্বরান্বিত করে, যা ক্যালোরি পোড়ানোর ক্ষমতা বাড়ায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ডিম, ডাল, দুধ, পনির, দই, মাছ, মুরগি ও সয়া জাতীয় প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার রাখা যেতে পারে।
প্রক্রিয়াজাত খাবারকে না
সাদা পাউরুটি, চিপস ও ক্র্যাকার্সে প্রায় কোনো ফাইবার থাকে না। ফলে এগুলো দ্রুত হজম হয় এবং হঠাৎ রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এভাবে এগুলো রক্তে শর্করার দ্রুত ওঠানামা ক্ষুধা বৃদ্ধি করে এবং ওজন বাড়ায়।

পাশাপাশি, এগুলো টাইপ-টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তৈরি করে। তাই, এসবের বদলে হোল গ্রেইন পাউরুটি, শুকনো তাপে বা ওভেনে বানানো নাশতা, ফল ও বাদামের মতো স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া উচিৎ।
চিনি ও ক্যালোরি-সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলার পাশাপাশি কম অ্যালকোহল গ্রহণ করতে হবে। আর ধূমপানকে সম্পূর্ণভাবে না বলতে হবে।
পর্যাপ্ত ঘুম
ঘুম কম হলে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনের ওপর প্রভাব পড়ে। ফলে খাবারের চাহিদা বেড়ে যায়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, ঘুমের ঘাটতি পাকস্থলীতে উৎপন্ন ঘ্রেলিন নামক হরমোনের মাত্রা বাড়ায়, যা ক্ষুধা বাড়ায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানসিক চাপের কারণে রক্তে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই মানসিক চাপ নেওয়া যাবে না ও মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে হবে। এই মানসিক চাপের সময় মানুষ খাবারের প্রতি কম মনোযোগী থাকে এবং মন অন্যদিকে সরাতে অস্বাস্থ্যকর কিছু খেয়ে ফেলে।
শারীরিক পরিশ্রম
ব্যায়াম করলে ও শরীরকে সক্রিয় রাখলে ক্যালরি খরচ হয়। এটি বিশেষভাবে পেটের চর্বি কমাতে সাহায্য করে। আর নিয়মিত হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং, সাঁতার বা যোগব্যায়াম শুধু চর্বি কমায় না, বিপাকক্রিয়াকেও ত্বরান্বিত করে। ব্যায়াম মাংসপেশি শক্তিশালী করে, হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখে। পেটের চর্বি কমলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন